বাংলা রহস্য গল্পের ইতিহাস


“.............আমাদের দেশের অপরাধগুলো ভীরু ও নির্বোধ; অপরাধগুলো নির্জীব ও সরল, তাহার মধ্যে দুরূহতা দুর্গমতা কিছুই নাই। আমাদের দেশের খুনি নর রক্তপাতের উৎকট উত্তেজনা কোনোমতেই নিজেদের মধ্যে অববরন করতে পারে না। জালিয়াত যে জাল বিস্তার করে তাহাতে অনতিবিলম্বে নিজেই আপাদমস্তক জড়াইয়া পড়ে। অপরাধবূহ্য হতে নির্গমনের কূটকৌশল সে কিছুই জানে না।”
বাঙালীদের ভালোমানুষিকতা (!) নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘ডিটেকটিভ’ ছোটগল্পে যতোই আক্ষেপ করুক না কেন; বাঙালীর মনের রহস্যের খাতা যিনি খুলতে পেরেছিলেন, তার পক্ষে তো বাঙালীদের রহস্যপ্রিয়তা নিশ্চয়ই অজানা নয়! নইলে তার পক্ষে ‘নিশীথে’, ‘কঙ্কাল’ কিংবা ‘গুপ্তধনের’ মতো লেখা সম্ভব হতো না! 
অবশ্য রহস্যপ্রিয়তা যে বাঙালীর নিজস্ব সম্পত্তি মোটেও তা নয়; বরং বলা যায় মানুষ মাত্রই রহস্যপ্রিয়।তা না হলে খৃস্টের জন্মের ৮০০ বছর পূর্বেই মহাকবি হোমার তার ওডিসি’র (Odyssey) মাধ্যমে যে রহস্যের রস মানবজাতিকে উপহার দিয়েছিলেন তার নেশা আজও কাটেনি।

শিরশিরে অনুভুতি জাগানো-সূক্ষ্ম বুদ্ধি আর যুক্তির খেলা আর সাথে সাসপেন্স-ক্লাইম্যাক্স পরিপূর্ণ এই গল্পগুলোতে সাধারণত দেখা যায় গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র তার সাদামাটা জীবনে হঠাৎ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় যেটা সমাধান করার জন্য তার সাথেসাথে পাঠককেও বাধ্য করে বিচিত্র এক জগতে হারিয়ে যেতে। রহস্যগল্পের এই ধারায় এখন প্রায় সকলের পরিচয় থাকলেও, পাঠকদের সাথে এই ধারার প্রথম পরিচয় ঘটে ১৮৪১ সালে প্রকাশিত এডগার অ্যালান পো’র ‘দ্যা মার্ডারস ইন দ্যা রু মর্গ’ (The Murders in The Rue Morgue) নামক গল্পে। এই গল্পের মাধ্যমেই অ্যালান পো পাঠকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন সি অগাস্ট দুপে (C Auguste Dupin) নামের পৃথিবীর প্রথম গোয়েন্দা চরিত্রটিকে। জাতে ফরাসি এই চরিত্রটিকে অ্যালান পো আবার পাঠকদের সামনে নিয়ে আসেন ১৮৪২ সালে প্রকাশিত ‘দ্যা মিস্ট্রি অব ম্যারি রজেট’ (The Mystery of Mary Roget) এবং ১৮৪৪ সালে প্রকাশিত ‘দ্যা পালওনড লেটার’ (The Purloined Letter) গল্প দুটিতে।
বাংলা সাহিত্যের এই গোয়েন্দা বা ডিটেকটিভ গল্পের আগমন মুলত ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে। এর আগেও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু অপরাধ কাহিনী বা গোয়েন্দা গল্প লেখা হয় যেমন এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে ‘বরকতউল্লার দপ্তর’ এর কথা। বরকতউল্লা নামক ঠগী দমনে নিযুক্ত এক দারোগার অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে যা লেখা হয়েছিল কিংবা ১৮৮৮ সালে বের হওয়া গিরিশচন্দ্র বসু’র ‘সেকালে দারোগার কাহিনী’ র কথা। তবে বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের সুচনা সম্পর্কিত আলোচনায় যে বইটির নাম আছে সেটি ১৮৯২ সালে প্রকাশিত প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘দারোগার দপ্তর’। লেখক প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় নিজেই ছিলেন পুলিশের ডিটেকটিভ বিভাগের কর্মচারী, যার ফলে বিভিন্ন ক্রাইম ও ডিটেকশনের ব্যাপারে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল কিন্তু এই লেখাগুলোতে সাহিত্যগুণের অভাব থাকার কারণে তা মূলত হয়ে উঠেছিল পত্রিকার প্রতিবেদনের মতো।
সেজন্য বাংলাসাহিত্যের প্রথম মৌলিক গোয়েন্দা গল্পের লেখকের নাম আসে পাঁচকড়ি দে’র।‘নীলবসনা সুন্দরী’, ‘মনোরমা’, ‘মায়াবী’, ‘হত্যাকারী কে?’ এগুলো ছিল তার কয়েকটি রহস্য উপন্যাস। পাঁচকড়ি দে যে সময় রহস্যগল্প লেখা শুরু করেন সে সময় ‘পেশাদার গোয়েন্দা’ নামক পেশাটির সাথে বাঙালী পাঠকদের কোনো পরিচয় ছিল না, সে জন্য তার গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলো হতো মূলত কর্মরত নয়তো অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের কর্মচারী। তার অনেক লেখাই বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। তবে পাঁচকড়ি দে একেবারেই মৌলিক লেখক ছিলেন না, তার বৈশিষ্ট্য ছিল বিদেশী ঘটনাগুলোকে দেশী ছাঁচে ফেলে পাঠকদের কাছে সরবরাহ করা। তিনি উইলিফ কলিন্স ও এমিল গাবোরিয়রের ধারা প্রথম দিকে অনুসরণ করলেও পরবর্তীতে স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের লেখা থেকে প্রচুর উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন।
বাংলা গোয়েন্দা গল্পে বিজ্ঞানের সার্থক প্রয়োগ ঘটান হেমেন্দ্রকুমার রায়। ১৯৩০ সালে ‘মৌচাক’ পত্রিকায় তার প্রথম গোয়েন্দা গল্প ‘যখের ধন’ প্রকাশিত হয়। তার পূর্বে লেখা বিভিন্ন গোয়েন্দা গল্পে এমনও পাওয়া যেত যে গল্পের নায়ক পুকুরে সাবমেরিন ভাসিয়েছেন কিংবা তার জামার পকেটে একসাথে টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ ভাঁজ করে রাখা যেত (!)।
সাধারণত দেখা যায় গোয়েন্দারা বিয়ে আর সংসার থেকে শতহাত দূরে থাকতেই ভালোবাসেন! পৃথিবীতে খুব কম গোয়েন্দাই আছেন যিনি প্রেমে পড়েছেন এমনকি বিয়েও করেছেন! বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমসের কথা বলে যেতে পারে তার কাছে  কেবলমাত্র একবারেই একটি মেয়েকে অন্যরকম মনে হয়েছিল (A Scandal in Bohemia)। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও যে আছে, কলকাতার কোয়াতলায় যিনি বাড়ি কিনে ছেলে বউ নিয়ে গুছিয়ে বসেছিলেন। নাম?  ব্যোমকেশ বক্সী। ১৯৩২ সালে ‘সত্যান্বেষী’ (কারো মতে ‘পথের কাঁটা’) দিয়ে আবির্ভাব ঘটে গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীর।যদিও গোয়েন্দা শব্দটির প্রতি ব্যোমকেশের একধরণের অ্যালার্জি ছিল, সে বরং নিজেকে সত্যান্বেষী হিসেবে পরিচয় দিতেই পছন্দ করতো। অনন্য এই চরিত্রটিকে নিয়ে লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন ৩৩টি সম্পূর্ণ ও ১টি অসম্পূর্ণ গল্প। প্রথম দিকে ব্যোমকেশের কাজকর্ম তার বন্ধু-সহকর্মী অজিতের ভাষায় উঠে আসতো, পরে শরদিন্দু নিজেই তৃতীয় পুরুষে লিখতেন।
বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলাসাহিত্যে বড়দের জন্য কিছু রহস্য গল্প-উপন্যাস থাকলেও কিশোরদের জন্য লেখার প্রাধান্যই বেশী চোখে পড়ে। বড়দের গোয়েন্দা কাহিনীর লেখক হিসেবে নীহাররঞ্জন গুপ্তের নাম অবশ্যই বলতে হবে। স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের মতো নীহাররঞ্জন গুপ্ত'ও প্রথম জীবনে ডাক্তার ছিলেন আর ডয়েলের মতো তার জীবনে পসার এনেছিল ডাক্তারি না লেখালেখি। তার গোয়েন্দা চরিত্রের নাম কিরীটি রায়। ইংল্যান্ডে ডাক্তারি পড়াকালীন সমেয়েই তিনি গোয়েন্দা গল্প নিয়ে বেশ উৎসাহী হয়ে পড়েন এবং এর জন্য বিখ্যাত রহস্য লেখিকা আগাথা ক্রিস্টির এমনকি সাক্ষাতও করেন। এরপর ভারতে ফিরে এসে ১৯৪৭ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘কালো ভ্রমর’ রচনা করেন যাতে তিনি কিরীটি রায়কে পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করেন।
‘প্রদোষচন্দ্র মিত্র’ ওরফে ‘ফেলু মিত্তির’ ওরফে ‘ফেলুদা’ এই নামগুলো শোনেননি এমন বাঙালী পাঠক খুঁজে পাওয়া দুস্কর। সেই ১৯৬৫ সালে ‘সন্দেশে’ বের হওয়া ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ দিয়ে ফেলুদার যে পথচলা শুরু হয় সেটা ১৯৯৫ এ এসে ‘ইন্দ্রজাল রহস্য’ র মাধ্যমে শেষ হলেও ফেলুদার জনপ্রিয়তা আজও কোনো অংশে কমেনি। এর মাঝেই ফেলুদার স্রষ্টা সত্যজিৎ রায় ফেলুদাকে নিয়ে লিখে ফেলেছেন ৩৫টি সম্পূর্ণ ও ৪টি অসম্পূর্ণ কাহিনী। ফেলুদার খুড়তুড়ো ভাই তপেশরঞ্জন মিত্র ওরফে তোপসে ছিল ফেলুদার সবগুলো অভিযানের সঙ্গী, তার জবানীতেই লেখা হতো ফেলুদার অভিযানগুলো আর এখানেই পাঠকদের সাথে পরিচয় ঘটে রহস্য-রোমাঞ্চ লেখক লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ুর। শুধুমাত্র লেখার প্রসাদগুণেই গল্পের জটিলতা না থাকা সত্ত্বেও ফেলুদা ছিল দুর্দান্ত এডভেঞ্চারের সাথে উপভোগ্য এমন কাহিনীর এক দুর্দান্ত প্যাকেজ।
অবসরপ্রাপ্ত এক কর্নেল। মাথাজোড়া টাক। চা আর চুরুটের প্রচণ্ড নেশা, বিরল প্রজাতির পাখি, ক্যাকটাস আর অর্কিডের খোঁজে পাহাড়-জঙ্গল ঘুরে বেড়ান। তবে এসব ছাড়া তার আরেকটা নেশা আছে, সেটা হলো জটিল সব রহস্য উদ্ঘাতন করা এবং যেখানে যান কেমন করে জানি রহস্য মিলেও যায়। কিন্তু এই কর্নেল বাস্তবের কোন চরিত্র নয়, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের সৃষ্ট বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র ‘কর্নেল নিলাদ্রি সরকার’। এই কর্নেল নিলাদ্রি সরকারকে নিয়ে প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাসটি ছাপা হয়েছিল ধারাবাহিকভাবে একটি সাময়িকীতে, যেটা পড়ে কর্নেলের দারুন ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায় (!) পরে ‘সন্দেশ’ পত্রিকাতেও ছাপা হয়েছিল কর্নেল আর ‘সন্দেশ’ এ কর্নেলের যে কাহিনীগুলো ছাপা হয়েছে আর অলংকরণ করেছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায় নিজে!
মধ্যবয়সি একজন মানুষ, গাড়ি দুর্ঘটনায় একটি পা অছল হয়ে গেছে, হাঁটেন ক্র্যাচে ভর দিয়ে, প্রাক্তন সরকারি প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের কর্মকর্তা। এই মানুষটি আর কেউ নয়, রাজা রায় চৌধুরী ওরফে কাকাবাবু। আর দশটা গোয়েন্দার মতো চোর-ডাকাতের পিছে ধাওয়া করেন না। বরং কাকাবাবু ছুটেন ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া সম্রাট কনিষ্কের হারিয়ে যাওয়া মস্তকের পিছনে। অদ্ভুত আলোক উৎসের সন্ধানে তিনি ভয়ংকর আন্দামানের জারোয়াদের মাঝে নামতেও পিছপা হন না। ক্রাচে ভর দিয়ে তিনি এভারেস্টে উঠেন আবার রহস্যভেদ করার জন্য তিনি পিরামিডের ভিতরে ঢুঁ মারতেও ভয় পান না। শারীরিক প্রতিবন্ধকটাকে তিনি জয় করেছেন অদম্য সাহস আর দুর্দমনীয় মনোবল দিয়ে। কাকাবাবু আর সন্তুর এডভেঞ্চারগুলো পাঠকের সামনে নিয়ে এসেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, যার সূচনা হয়েছিল ‘ভয়ংকর সুন্দর’ দিয়ে। 
তবে, রহস্য গল্প বলতে তো সুধুমাত্র গোয়েন্দা গল্প কিংবা অ্যাডভেঞ্চার বোঝায় সেটা নয়, শিকার কাহিনিও যে রহস্য গল্প হতে পারে সে ধারণা বাঙালী পাঠকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন ‘বুদ্ধদেব গুহ’ (যিনি আবার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর ভাগ্নে) তার ‘ঋজুদা’ নামক কল্পিত চরিত্রটি দিয়ে। বাংলা ভাষাভাষী কিশোর-কিশোরীদের মনে প্রকৃতিপ্রেম, পাখ-পাখালি, গাছ-গাছালি এবং আমাদের বিরাট বৈচিত্র্যময় সাধারন গ্রামীণ এবং পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষ সম্বন্ধে উৎসাহী ও ভালোবাসা উদ্রেককারী ঋজুদা চরিত্রটিকে বুদ্ধদেব গুহ প্রথম পাঠকদের সামনে নিয়ে আসেন ১৯৭৩ সালে ‘রিজুদার সাথে জঙ্গলে’র মাধ্যমে। লেখক নিজেও ছিলেন শিকারি আর শিকার কাহিনীতে তার জুড়ি মেলা ভার, তাই নিজের লেখনীর মাধ্যমে জঙ্গলের একেবারে নিজস্ব চেহারা ঋজুদার মাধ্যমে পাঠকদের কাছে তুলে ধরেছেন। 
এবার এমন দুটো জনপ্রিয় চরিত্রের প্রসঙ্গে আসতে চাই যারা আদপে রহস্যগল্পের কোনো চরিত্র নয়, কিন্তু তাদের গল্পের বর্ণনায় অ্যাডভেঞ্চার আর রহস্যের পাশাপাশি থাকতো প্রচণ্ড হাস্যরস। 
প্রথমজনের নাম ‘শ্রীঘনশ্যাম দাস’। রোগা-লম্বা, শুকনো হাড় বার করা বাঙালী বাক্যবাগীশ মানুষটির বয়স আন্দাজ করা অসম্ভব, ৩৫ থেকে ৫৫ বছর যেকোনো বয়স তার হতে পারে! দুনিয়াময় টহলদারি নাকি তার কাজ। পৃথিবীর এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তিনি যাননি, এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যার সঙ্গে তার কোন সংযোগ নেই।
সেইসব আশ্চর্য দেশের আশ্চর্য ঘটনা বলার জন্য ঘনাদা মাঝে মাঝে মেসের টঙ্গের ঘর থেকে নিচে দোতলায় আড্ডার ঘরে নামতেন আর ৭২ নম্বর বনমালী নস্কর লেনের মেসে চোখ গোলগোল করে সেই গল্প শোনে শিশির, শিবু, সুধীর আর গৌরেরা। এই মহাপ্রতাপশালী ঘনাদার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৪৫ সালে ‘মশা’ নামক এক গল্পের মাধ্যমে। চরিত্রস্রষ্টা প্রেমেন্দ্র মিত্র এই ঘনাদাকে নিয়েই এরপর লিখে ফেলেন ৬৫টি গল্প আর ৪টি উপন্যাস।
ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্তোফিলিস ! ইয়াক!! ইয়াক !!!
এই একটা লাইন মাথায় আসতে বাধ্য পৃথিবীর প্রচণ্ড বিভীষিকা – পটলডাঙ্গার টেনিদা। পুরো ছয়হাত লম্বা ঘটঘটে জোয়ান। গড়ের মাঠে গোরা ঠেঙ্গিয়ে এবং মোহনবাগান হারলে রেফারি পিটিয়ে স্বনামধন্য। সাথে ক্রিকেট মাঠের ক্যাপ্টেন, ফুটবল মাঠের ত্রাস। বছরে বছরে পরীক্ষায় ফেল মারা টেনিদাকে প্রায় দেখা যায় চাটুজ্যের রকে বসে কিছু না কিছু চিবুচ্ছেন। গল্পকার প্যালারামের জবানীতে টেনিদার আজব কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি উঠে এসেছে ঢাকাইয়া হাবুল সেন আর ক্যাবলার কথা। এই টেনিদা আর সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে ‘চার মূর্তি’ নামে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৫৭ সালে উপন্যাস লেখেন।
এবার একটু পশ্চিম বাংলা থেকে পূর্ব বাংলার দিকে নজর দেওয়া যাক। এদেশে স্বাধীনতা পূর্ব প্রজন্মের সবচেয়ে প্রিয় রোমাঞ্চ সিরিজ ছিল ‘দস্যু মোহন’। রবিন হুডের আধুনিক সংস্করণ সর্বগুণের আধার দস্যু মোহনকে নিয়ে শশধর দত্ত লিখেছেন প্রায় ২০০ বই। বিদেশী কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে লেখা এসব কাহিনী চল্লিশ-পঞ্চাশ আর ষাট দশকে ছিল এক নম্বর বেস্টসেলার।

দস্যু মোহনের মতো আরেকজন, সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক দস্যু বনহুর। এই স্লোগান নিয়ে রোমানা আফাজ তৈরি গরীবের বন্ধু ও চোরাকারবারিদের চিরশত্রু দস্যু বনহুর চরিত্রটিকে। ছোটবেলায় চৌধুরীবাড়ির ছেলে মনির হারিয়ে যায়। পরে তাকে কুড়িয়ে পায় দস্যু সর্দার কালু খাঁ এবং পরবর্তীতে গড়ে তুলেন দস্যু বনহুর হিসেবে।জনপ্রিয় এই চরিত্রটিকে নিয়ে প্রায় ১৩৬টি গল্প প্রকাশিত হয়।
এদেশের পাঠকের রহস্যগল্পের হাতেখড়ি যদি দস্যুদের হাতে হয়ে থাকে তাহলে তার বিস্তার হয়েছে সেবার মাধ্যমে! ‘সেবা প্রকাশনী’ বাংলাদেশের একটি সুপরিচিত প্রকাশনা সংস্থা। বাংলা রহস্যগল্পের অদম্য গতিতে এগিয়ে চলার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানটি হচ্ছে সেবা প্রকাশনীর। এই প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘কুয়াশা’, ‘মাসুদ রানা’, ‘তিন গোয়েন্দা’, ‘কিশোর হরর’, ‘গোয়েন্দা রাজু’, ‘রোমহর্ষক’ সহ প্রত্যেকটি সিরিজি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তবে প্রকাশের পর থেকেই জনপ্রিয়তার শিখরে আছে এমন সিরিজের নাম উঠলেই যে দুটো নাম সবার প্রথমে আসবে সে দুটো হলো ‘মাসুদ রানা’ ও ‘তিন গোয়েন্দা’। 
বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রথম একটি চরিত্র যা বাঙালী হলেও বৈশ্বিক চরিত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে! ‘মাসুদ রানা’ নামক এই চরিত্র স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন। মাসুদ রানা বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এক দুঃসাহসী স্পাই। গোপন মিশনে ঘুরে বেড়ান দেশ-দেশান্তরে। বিচিত্র তার জীবন। অদ্ভুত রহস্যময় তার গতিবিধি, কোমলে কঠোরে মেশানো। টানে সবাইকে কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না। কোথাও অন্যায় অবিচার অত্যাচার দেখলে রুখে দাড়ায়। পদে পদে তার বিপদ-শিহরণ-ভয় আর মৃত্যুর হাতছানি। ঠিক এমনভাবেই পাঠকদের সামনে মাসুদ রানাকে উপস্থাপন করা হয়েছে প্রথম ১৯৬৬ সালে ‘ধ্বংস পাহাড়’ উপন্যাস দিয়ে। সেই থেকে যে শুরু হলো তার আজ পর্যন্ত নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে মাসুদ রানাকে নিয়ে ৪০০’র বেশী বই বের হয়েছে। মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম দুটি বই ‘ধ্বংস পাহাড়’ আর ‘ভারতনাট্যম’ বাদ দিয়ে বাকিগুলো মূলত ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার বইয়ের ভাবানুবাদ বা ছায়া অবলম্বনে রচিত।
তিনজন কিশোর। তারমধ্যে একজন জন্মসূত্রে বাঙালী, আরেকজন আমেরিকান নিগ্রো আর তৃতীয়জন আইরিশ আমেরিকান। থাকেও আবার বাংলাদেশে নয় আমেরিকার লস অ্যাঙ্গেলসের কল্পিত রকি বিচ শহরে। কিশোর, মুসা আর রবিনকে নিয়ে গড়ে উঠা ‘তিন গোয়েন্দা’ নামক সিরিজি বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সেই ১৯৮৫ সালে আগস্ট মাসে প্রকাশিত হয়েছিল তিন গোয়েন্দার প্রথম বই ‘তিন গোয়েন্দা’। প্রথম থেকেই রকিব হাসান এই বিখ্যাত সিরিজটি লেখেন এবং ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে একটানা ১৮০টি গল্প লেখেন। তারপর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত শামসুদ্দীন নওয়াব ছব্দনাম নিয়ে লিখে যাচ্ছেন কাজি আনোয়ার হোসেন। তবে তিন গোয়েন্দা পুরোপুরি মৌলিক কাহিনী নয়। ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন গোয়েন্দা কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে রচিত। বিশেষ করে প্রথম দিককার বইগুলো রবার্ট আর্থারের ‘থ্রি ইনভেস্টিগেটরস’ (The Three Investigators) এর ছায়া অবলম্বনে রচিত। আবার কিছু বই এনিড ব্লাইটনের ‘ফেমাস ফাইভ’ (Famous Five) অবলম্বনে রচিত। 
লোকটির বয়স ৪০-৫০ বছর। লম্বাটে মুখে এলোমেলো দাড়ি, লম্বা উস্ক-খুস্ক কাঁচাপাকা চুল, কিছুটা আত্মভোলা; প্রথম দেখায় ভবঘুরে মনে হতে পারে কিন্তু মোটেও তিনি সেরকম কেউ নন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান (Psychology) বিভাগের খণ্ডকালীন সহযোগী অধ্যাপক। তিনি মানুষের মন, আচরণ, স্বপ্ন এবং বিভিন্ন রহস্যময় ঘটনা নিয়ে বেশ আগ্রহ রাখেন। এরকম চরিত্রের একজন মানুষকে হুমায়ূন আহমেদ ‘মিসির আলি’ নাম দিয়ে পরিচয় করিয়ে দেন তার ‘দেবী’ উপন্যাসে। লেখক মিসির আলিকে এমন একজন মানুষ হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছেন, যার কাছে প্রকৃতির নিয়ম শৃঙ্খলা বড় কথা, রহস্যময়তার অস্পষ্ট জগত তিনি স্বীকার করেন না। এই চরিত্রটিতে লেখক বিপরীতধর্মী দুটি বৈশিষ্ট্য ‘যুক্তি’ এবং ‘আবেগ’ কে স্থান দিয়েছেন। মিসির আলির কাহিনীগুলো ঠিক গোয়েন্দা কাহিনী নয় কিংবা ক্রাইম ফিকশন কিংবা থ্রিলারের মতো খুনি-পুলিসের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া নয় বরং মনস্তাত্ত্বিক প্রচণ্ড যুক্তি নির্ভর।
রহস্য গল্প বলা যাক কিংবা থ্রিলার যাই হোক না কেন, বাঙালী পাঠকদের সাথে তার পরিচয় ঘটে মুলত বিদেশী গল্প কিংবা বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখাগুলোর মাধ্যমে। দুটোতেই ঠিক ঢাকার রাস্তার অলিতেগলিতে চরিত্রগুলোর পদশব্দ শোনার মজাটা পাওয়া যায় না। ঠিক তেমনি হাহাকার শোনা যায় কাহিনীর মৌলিকতার জন্য, যে হাহাকার অবশেষে কিছুটা লাঘব হয়েছে মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের মাধ্যমে। অনুবাদক হিসেবে বেশ পরিচিত হলেও তার ‘জেফরি বেগ বাস্টার্ড’ সিরিজের কয়েকটি বই ছাড়াও কয়েকটি মৌলিক থ্রিলার গল্প পাঠকমহলে বেশ সাড়া ফেলেছে।

Comments

Popular posts from this blog

বিনীতা এখন কেমন আছো

ইজমের ঘরবসতি (পর্ব ১)