বিনীতা এখন কেমন আছো


       আজন্ম রবীন্দ্রনাথের আবহে বেড়ে উঠা প্রজন্মের কাছে বিষ্ময়ের মত ছিল জীবনানন্দের কবিতার পাতা ফুঁড়ে উঠে আসা মহীনের ঘোড়াগুলি আর তাদের মায়াবী ডাক। ভীতু মানুষের ভীড়ে অস্থির সেই মুহূর্তটিতে 'মহীনের ঘোড়াগুলিএকটি স্বপ্নের নাম, আবার একটি স্বপ্নভঙ্গের নাম। এবং একটি আন্দোলনের নাম।
দুঃখী মানুষের শোকে কনসার্টে গান গায় কত মায়েস্ত্রো

       ৭০'এর মাঝামাঝির উষ্ণতম দিনগুলোতে এসেছিলপরিবর্তনের হাওয়া ছড়িয়ে বয়ে এনেছিল বাংলা গানে এক নতুন ধারার সঙ্গীত। গিটার, ভায়োলিন আর সেক্সোফোন ছুঁয়ে সেই সাঙ্গীতিক পরিবর্তনের সুর পৌছে গিয়েছিল পার্কস্ট্রীটের সাহেব পাড়া থেকে কলকাতার অলিগলি পর্যন্ত। এবং কলকাতার গতানুগতিক সঙ্গীতের ধারা বদলে যাওয়ার কথা আলোচনা করতে হয় তাহলে সবার আগে 'মহীনের ঘোড়াগুলি' নাম বলতে হবে। যদিও ৬০'এর শেষে কিংবা ৭০'এর শুরুতে বাংলা গানের মরণদশা ছিল না, তবুও সে সময়টাতে গতানুগতিকতার প্রভাবটা প্রবল ছিল। শব্দ- সুরের যে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জায়গা আছে, সেটা কারো চিন্তা করার দরকার পর্যন্তই হয়নি। সেই সময়টিতে সারা পৃথিবীতে যখন সাহিত্য-পেইন্টিং-মিউজিকের ক্ষেত্রে অনেক নতুন নতুন কাজ হচ্ছিল, ডিলান-জিম মরিসন-বিটলসরা নতুন আবহ সৃষ্টি করছে; সেই সময়টাতে বাংলা গান তার গতানুগতিকতাকে ছাড়তে পারে নি (!)
তাই তো বলি ,আমায় তুমি ঘেন্না করো 

       শিরেসংক্রান্তির ১৯৭৪' এসে আবির্ভাব ঘটে 'মহীনের ঘোড়াগুলি'র। দলের প্রাণপুরুষ গৌতম চট্রোপাধ্যায় ওরফে মণিদা। ১৯৬০ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজে মনোবিজ্ঞান পড়ার সময় তার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বন্ধুদের নিয়ে গঠন করে দ্যা আর্জনামক একটি ব্যান্ড, মূলত ইংরেজী ব্যান্ড। মণিদা ভোকালিষ্ট এবং লিড গিটারিষ্ট। ৭০'কে বলা হত মুক্তির দশক। সারা পৃথিবী জুড়ে স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা সোচ্চার হয়ে উঠেছিল বিভিন্ন অন্যায়ের প্রতিবাদে। গৌতম নিজেও ৬৯-৭০'এর দিকে জড়িয়ে পড়ে নকশাল বাড়ি আন্দোলনের সাথে। এবং সেজন্য পরবর্তীতে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার নির্যাতিতও হয়েছিল।
তোমরা বলছ অবাধ্য জীবনের আট আনায় ফাঁকি
  
       এই আন্দোলন-প্রতিবাদকে প্রশাসন দমন করে ফেলেছিল, কিন্তু পারেনি কাজ করার প্রেরণাকে দমন করতে। শুরু হলো নতন উদ্যেগ। গৌতম চট্টোপাধ্যায়, সাথে তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রঞ্জন ঘোষাল, তাপস দাস, এব্রাহাম মজুমদার, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায় আর প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়; এই সাতজন মিলে শুরু করলেন নতুন আন্দোলন। তাদের গানের মাধ্যমে শুরু হলো নিয়ন আলোয় নগরবাসীর ঘরে ফেরার গান, নষ্টালজিক অসহায় জীবনচিত্র বা পরিত্যক্ত রানওয়ের স্বপ্ন দেখা কিংবা পুরনো ট্রামের সারিদের বিচ্ছিন্নতার গল্পগুলো।
তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে 

       দলে সাতজন থাকার কারণে নাম হয়ে গেল সপ্তর্ষি এক অনুষ্ঠানে নিজেদের নাম সপ্তর্ষিবলে ঘোষণাও দেওয়া হলো। কিন্তু নাম বদলাতে থাকত। একবার হঠাৎ ঘোষণা দেওয়া হয় ব্যান্ডের নাম 'গৌতম চ্যাটার্জি বিএসসি অ্যান্ড সম্প্রদায়' নামকরণ নিয়ে এরকম হাসি-খেলা চলতেই থাকত। অবশেষে একদিন ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য রঞ্জন ঘোষাল এসে প্রস্তাব করে 'মহীনের ঘোড়াগুলি' এবং এরপর থেকে আর নাম পাল্টায়নি। কেন এই নাম এই প্রশ্নের অনেক ব্যাখ্যা প্রচলিত রয়েছে, তবে ব্যান্ডের বেস গিটারিষ্ট প্রদীপ চট্রোপাধ্যায় এক আলাপচারিতায় নামকরণের প্রসঙ্গে বলেন,
জীবনানন্দের 'ঘোড়া' কবিতার ঘোড়াগুলি স্বাধীনতার প্রতীক, ঘোড়াগুলো মুক্ত, কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে চড়ে বেড়ানোয় তারা আস্তাবলে বাঁধা নেই। এগুলোর প্রভাব রয়েছে, এসমস্ত কিছুই আমাদের মহীনের ঘোড়াগুলি নামকরণের ব্যাপারে আমাদের উৎসাহিত করেছিল।
সুদিন কাছে এসো, ভালোবাসি একসাথে সবকিছু

       গানের মাঝে নতুনত্ব থাকলেও শ্রোতাদের মধ্যে খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছিল না। এই প্রসঙ্গে বলা যাতে পারে কলকাতা দূরদর্শনেরকথা। অডিশন ছিল সেখানে, কিন্তু সেখানে আবার যন্ত্রপাতি নিয়ে গান গাওয়া যায় না।এই নিয়ে দূরদর্শনের লোকজনের সাথে তাদের কথা কাটাকাটি শুরু হয় এবং এক পর্যায়ে তাদের বলা হয়, ‘মহীনের ঘোড়াগুলিযে গানগুলো গায়, সেগুলো নাকি গানই  না (!)
আমার মহান হবার সাধই জাগে/ মহান হতে পারি না/ আমি যে সাধ আহ্লাদ ছাড়িনে

       প্রজন্মকে দিতে চেয়েছিল ছড়ানো মেঘের স্বাদ। ব্যপক উৎসাহ ভরে সেজন্য তৈরি করেছিল প্রথম অ্যালবাম সংবিগ্ন পাখিকূল কিন্তু ঠিকানাহীন বাড়ির পেছনে হাতড়িয়ে চলা মানুষগুলোর পছন্দের সাথে ঠিক যেনো গেলো না! 

       বাড়তে থাকে হতাশা। তাইতো ৭৪' শুরু হওয়ার পরে ৭৬ থেকে ৮১ মাত্র ছয় বছরে ৩টি অ্যালবাম আর ১৫/১৬টির মতো স্টেজ পারফর্মেন্সে ঘোড়াগুলিকে বিচরণ করতে দেখা গিয়েছিল, তার পরে আর তাদের গাইতে দেখিনি কেউ। দীর্ঘকালের জন্য চলে গিয়েছিল লোকচক্ষুরে আড়ালে।

কাউকে চেনো না তুমি, তোমাকে চেনে না কেউ সেইতো ভালো 

       পরবর্তিতে ৮০'এর শেষের দিকে প্রেসিডেন্সী কলেজের সুব্রত ঘোষাল এবার ঘোড়াগুলির মোহে বাঁধা পরে। শুরু হয় সন্ধান পর্ব এবং পুনরুত্থান। ততদিনে সুমন, অঞ্জনের কল্যাণে ভিন্ন আঙ্গিকে গান শোনার প্রচলন শুরু হয়। এবার বোধহয় দক্ষিণের জানালার ডাক এসেছে। ৯৫' এর কলকাতা বইমেলায় এসে ঘুম ভাঙ্গে আবার বছর কুড়ি পরেদিয়ে। বিশ বছর আগে যে গান অবহেলায় প্রত্যাখিত হয়েছিল, বিশ বছর পরে সেটিই জনপ্রিয়তা পায়।
কত কি করার আছে বাকী/ বেলা বয়ে যায়/ কি করে এভাবে আমি থাকি 

     ব্যর্থ নাকি সফল, সেটি বরং সময় নির্ধারণ করে দিবে, কিন্তু মহীনের ঘোড়াগুলি চেয়েছিল একটা পরিবর্তন, যেটা পুরাতনকে ভেঙ্গেচূড়ে নতুন কিছু নিয়ে আসবে। এবং মহীনের ঘোড়াগুলি সেটা করতে পেরেছে। 





Comments

Popular posts from this blog

বাংলা রহস্য গল্পের ইতিহাস

ইজমের ঘরবসতি (পর্ব ১)