ইজমের ঘরবসতি (পর্ব ১)

ইজমের ঘরবসতি! 
নাম শুনে বিভ্রান্ত হওয়ার যথেষ্ঠ সম্ভাবনা আছে! শুধু সম্ভবনাই না, গোলকাধাঁধায় হারিয়েও যেতে পারেন! কেন?

প্রথমত, কোন ইজম বলতে যেটা বোঝাতে চেয়েছি, সেটা মূলত দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা বা আন্দোলনের ফসল। হুট করে আমার মাথায় কিছু একটা আসল, আর ব্যাস অমনি হয়ে গেল! মোটেও তেমন না।
প্রত্যেক ইজমের পেছনে যে দর্শনের ভিত্তি রয়েছে, এখানে সেগুলো নেই! আর যদি কিছুটা থেকে থাকেও তাহলে ধোঁয়াশার মত বিররণ রয়েছে!

দ্বিতীয়ত,  আগেই বলেছি ইজমের দর্শনগুলো এখানে পাবেন না, এমনকি এখানে ইজম বলতে যেটা আলোচনা করার চেষ্টা করা হয়েছে সেই শিল্পকলার সামগ্রিক রুপটিও পাবেন না! শুধুমাত্র চিত্রকলা- স্থাপত্য আর হয়ত ভাস্কর্য এসব কিছু অংশবিশেষ পেলে পাওয়া যেতে পারে।

তৃতীয়ত, শিল্পকলার নাম উল্লেখ করলাম। কিন্তু এখানে প্রাগৈতিহাসিক শিল্পকলা নিয়ে কোনপ্রকার আলোচনা না করেই হঠাৎ করেই রেনেসাঁর নাম ভাঙিয়ে চলার চেষ্টা করা হয়েছে! এবং যতটা আতর্কিতভাবে শুরু করা হয়েছে, ঠিক ততটাই আতর্কিতভাবে সমাপ্তি টানা হয়েছে!
সুতরাং, সাবধান!  

অবশ্য আত্নপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকলেও, সেটা হবে নির্বুদ্ধিতা।

এজন্য আর কথা না বলা, আমাদের কাল্পনিক টাইম মেশিনে করে আমরা চলে যাব মধ্যযুগে। রেনেসাঁর সুচনালগ্নে। এখান থেকেই আমাদের যাত্রাপথের শুরু হবে...

রেনেসাঁঃ (১৪৫০-১৬০০)
মোনালিসা- লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি

রেনেসাঁ মানে নবজাগরণ বা পুনোরুত্থান, এটা আমরা জানি
এবং সেই সাথে এটাও জানি মধ্যযুগে বন্ধ্যাত্বের পর এই সময়ে ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে শুরু হয় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কিরকম সেটা?
রেনেসাঁ ছিল মূলত একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন। পোপের শাসন কিংবা শোষণ যাই বলি না কেন, সেটা থেকে মুক্তি পেয়ে শিল্প কেবল আর ধর্মপ্রচারের মাধ্যম হিসাবে না থেকে ব্যক্তিচিন্তার প্রকাশ মাধ্যম হিসাবে চিহ্নিত হতে শুরু করল

রেনেসাঁ মানে যদি নবজাগরণ হয়ে থাকে তাহলে সেটা কিসের নবজাগরণ?
ওকে, রেনেসাঁর জন্মভূমি ইতালির কথা যদি বলি, তাহলে এর উদ্দেশ্য ছিল 
গ্রীক ও রোমান ভাবাদর্শ, যেগুলো কিনা অ্যারিষ্টটলের প্রভাবে দীর্ঘদিন ধরে চাপা পড়ে ছিল এবং শিল্প-সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন। এ সময়কার চিত্র, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের সাথে ফ্লোরেন্স, ভ্যানিস ও রোমের অপূর্ব সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়।
ডেভিড- মাইকেলেঞ্জেলো

তাহলে তো রেনাসাঁ মানে পশ্চাৎপদটা (!) 
বিষয়টা আপাতদৃষ্টিতে সেরকম মনে হলেও, মোটেও সেটা না। যদিও রেনেসাঁ শিল্পের মূল অনুপ্রেরণা ছিল গ্রীক ও রোমান শিল্পকলা কিন্তু তারমানে এই না রেনাসাঁর সময়কার শিল্পকলাগুলো শুধু সেটাতেই আবদ্ধ ছিল!
দ্যা ক্রিয়েশন অব অ্যাডাম- মাইকেলেঞ্জোলো
বরং রেনেসাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের কথা যদি বলি, তাহলে সেটা হচ্ছে, শিল্প ও বিজ্ঞানের যুগলবন্দী।
এবং সেটা এতটাই ভয়াবহ (!) ছিল যে অতীতকে সঙ্গে নিয়ে ভবিষ্যতের পানে বয়ে চলা ঢেউের প্রভাবে ধীরে ধীরে ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলে যেমন উত্তর ফ্রান্স, হল্যান্ড, স্পেন, জার্মানী, হাঙ্গেরীতে শিল্পকলার ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়।

লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি (Mona Lisa, The Last Supper, Madonna), মাইকেলেঞ্জেলো (David, The Creation of Adam), রাফায়েল (The School of Athens, La Bella Jardiniere) এরা মূলত এই রেনেসাঁর ফসল কিংবা বলা যায় এদের হাত ধরে রেনেসাঁ যুগের শিল্পকলা নতুন মাত্রা পেয়েছে। 
দ্যা স্কুল অব এথেন্স- রাফায়েল

রোমান্টিসিজমঃ (১৭৭০-১৮৪০)

“Romanticism is precisely situated neither in choice of subject nor exact truth, but in a way of feeling”
মনে করুন, আপনি প্রেমিক অথবা প্রেমিকার হাত ধরে রেললাইন ধরে হেঁটে যাচ্ছেন বা তার সাথে বসে জ্যোৎস্না দেখছেন কিংবা এরকম কোন যুগল কে দেখে বলে উঠলেন, হাউ রোমান্টিক!
আপনি যদি মনে রোমান্টিসিজমের মূল থিম হলো এই আবেগ, ভালোবাসা। তাহলে আপনার অনুমান ঠিক আছে। তবে একেবারে ঠিক না, তার কিছুটা ধার ঘেঁষে চলে গেছে।
তাহলে রোমান্টিসিজম বলতে মূলত কি বোঝায়?
রোমান্টিসিজমের শুরুটা হয় জার্মানিতে। শিল্প-সাহিত্য কিংবা সাংস্কৃতিক এই যুগের মূল থিমের কথা যদি বলি, তাহলে নাম চলে আসবে “অনুভূতি”, “কল্পনা”, “আবেগ” (একটু আগে কিন্তু আপনি ঠিক এটাই মনে করেছিলেন), “আকুতি”।
দ্যা বডি অব অ্যাবল বাই অ্যাডাম এন্ড ইভ- উইলিয়াম বেক
রেনেসাঁর সাথে রোমান্টিসিজমের প্রচুর মিল আছে। কিরকম?
রেনাসাঁর মতই রোমান্টিসিজমে প্রত্যেক ব্যক্তিসত্তার স্বাতন্ত্র্যের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। এবং মানুষের উপর শিল্পবোধের যে প্রভাব রয়েছে সেটার যথাযথ প্রয়োগ।
দ্যা স্লিপ অব রিজন- ফ্রান্সিককো দ্যা গইয়া
রোমান্টিকরা বিশ্বাস করত, যা কিছু কথা দিয়ে প্রকাশ করতে পারব না, সেটার কাছে পৌছাতে হলে আমার একমাত্র মাধ্যম হবে শিল্পী। এবং শিল্পীর কাজ হবেই মাত্র নিজের জগতে স্বাধীনভাবে বিচরণ করা, কারো দাসত্ব নয়।
রেনেসাঁর যে স্লোগান ছিল, ফিরে চল প্রকৃতির কাছে...
তাকে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে রোমান্টকরা।
শিল্পক্ষেত্রে মূলত চিত্রকলাই রোমান্টিসিজম দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে। এতে প্রকৃতি ও মানব প্রকৃতির অপূর্ব সমন্বয় ঘটে। মধ্যযুগের সাহিত্য ও সমকালীন বীরত্বমূলক কাহিনীকে ভিত্তি করে আবেগময় ও কল্পনাময় শিল্প সৃষ্টি করে এ ধারা।
থার্ড অফ মে- ফ্রান্সিসকো দ্যা গইয়া
এ ধারায় সর্বপ্রথম প্রাচ্যদেশীয় রীতি, জীবন ও সমাজ পাশ্চাত্য শিল্পধারায় স্থান পায়।
উইলিয়াম বেক (
The body of Abel found by Adam and Eve, Nebunchadnejjar) কিংবা ফ্রান্সিসকো দ্যা গইয়া (The Sleep of Reason, Third of May- 1808) বা জে. এম. উইলিয়াম টার্নার (The Fighting Temeraire, Snow Storm) এরা সবাই এই রোমান্টিসিজমের প্রতিনিধি করে চলছে।    
দ্যা ফাইটিং টিমেরাইর- জে. এম. উইলিয়াম টার্নার

রিয়েলিজম বা বাস্তববাদঃ (১৮৪৫-১৮৮০)

বাস্তবতা! বাস্তবতা কি?
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে ফ্রান্সে একদল মানুষ একট্টা হয়ে চিৎকার করে উঠল, না প্রথাগত শিল্প কিংবা রোমান্টিসিজমের কল্পনা আর নয়। শিল্পকলা হতে হবে আমি যেটা দেখছি, ঠিক সেটাই।
বাস্তবের হুবুহু অনুকরণ ছিল এই আন্দোলনের প্রধান স্লোগান।
দ্যা থার্ড ক্লাশ ক্যারিজ- জেন ফ্রাঙ্কিসমিলে
এ যুগের চিত্রকলাগুলোকে যদি গঠনগত দিক থেকে দেখা যায়, তাহলে সেগুলো মূলত শিল্পায়ন ও পুঁজিবাদ বিকাশী যুগের শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা ও অভিজাতদের ব্যঙ্গ করে সৃষ্টি করা।
স্টোন ব্রেকার্স- গুস্তাভ কুর্বে
গুস্তাভ কুর্বে (Stone Breakers) ছিল বাস্তবতাবাদ বা রিয়েলিজম আন্দোলনের পুরোধা। সেই সঙ্গে পাশে পেয়েছিলেন রোসা বোনহ্যার (Plowing in the Nivernais), জেন ফ্রাঙ্কিসমিলে (The Third Class Carriage) প্রমুখকে।  


Comments

Popular posts from this blog

বাংলা রহস্য গল্পের ইতিহাস

বিনীতা এখন কেমন আছো