অদ্ভুত ভালো লোকটা

১৯১৯ সাল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেটে এসেছেন। ছাত্রদের সামনে বক্তৃতা দেবেন। কি নিয়ে?
হতচ্ছাড়া বলে কি!!!
কবিগুরুর পক্ষে কি কথা বলার বিষয়ের অভাব আছে নাকি হে? স্বাভাবিকভাবেই অনেক কিছুই নিয়েই বলেছিলেন। কিন্তু এই অধমের পক্ষে কেবলমাত্র জানা সম্ভব হয়েছে, তিনি ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
যার লেখনী পাঠকের হৃদয় আকাশ ওলট-পালট করে দেবার জন্য যথেষ্ঠ ক্ষমতা রাখে, তার বক্তৃতা শ্রোতাদের মধ্যে মুগ্ধতার রেণু ছড়াবে না (!) সেটা তো কল্পনাতেও আনা সম্ভব না!  

তা ঠিক
কিন্তু একজনের মধ্যে সম্ভবত একটু বেশিই মুগ্ধতা জড়িয়ে গিয়েছিল। আগে-পিছে কোন কিছু না ভেবেই, কারো সাথে পরামর্শ না করেই কবিগুরুকে চিঠি লিখে বসেন (!) তাও সাধারণত যেটা করা হত কিংবা হয়, লেখনীর কিংবা অকালকুষ্মান্ড হলে বক্তৃতার প্রশংসা করে লিখবেমোটেও সেরকম নয়।কবিগুরুকে জিজ্ঞেস করেছে, আকাঙ্ক্ষা উচ্চ করতে হলে কি করা প্রয়োজন?

তা এটা এমন কি আর! নাক সিটকিয়ে বলে উঠতে পারেন। এমনকি বাঁজখাই গলায় বলে উঠতে পারেন, আমিও আমার প্রেমিকাকে চিঠিতে প্রশ্ন করেছিলুম, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো? কই সে তো কিছুই উত্তর দেয় নি! আর এখানে স্বয়ং কবিগুরু!

সবাই ইতিমধ্যেই বুঝে ফেলেছেন, গল্পে থ্রিল ধরে রাখার জন্য আমি কিছুটা নাটকীয়ভাবে বলে উঠব, যথার্থ; কবিগুরু সে চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন।  
কিন্তু, সত্যি বলছি। খোদার কসম, বিশ্ব সাক্ষী; আমার নাটকীয়তার কোন প্রয়োজন নেই। কবিগুরু সে চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন। ১০-১২ লাইনের এই চিঠির সারমর্ম ছিল, আকাঙ্ক্ষা উচ্চ করতে হবে, এ কথাটার মোটামুটি অর্থ এই যে, স্বার্থই যেন মানুষের একমাত্র কাম্য না হয়। দেশের মঙ্গলের জন্য ও জনসেবার জন্য স্বতঃস্ফূর্ততাই মানুষকে কল্যানের পথে নিয়ে যায়। তোমার পক্ষে কি করা উচিত তা এতদূর থেকে বলে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে তোমার অন্তরের শুভেচ্ছাই তোমাকে কল্যানের পথে নিয়ে যাবে।
ব্যাস! পাগোলকে সাঁকো নাড়ানোর কথা বলে দিলেন!

পিছনে পরে রইল বাবা-মা, আত্নীয়-স্বজন, ভিটেমাটি। সবকিছু ছেড়ে রওনা দিলেন শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে। তখন কেবলমাত্র বিশ্বভারতী স্থাপিত হয়েছে। একে তো নতুন, তারপর সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা হওয়ায় এখানকার ডিগ্রী ছিল সম্পূর্ণ অমূল্য (!) মানে হইল, মূল্যহীন।
তাতে ছেলেটির থোড়াই কেয়ার! তার তো প্রধান উদ্দেশ্য গুরুদেবের সান্নিধ্য! এবং সেটা পেয়েছিলও বটে। টানা পাঁচ বছর গুরুদেবের কাছ থেকে পড়েছেন বলাকা, শেলি ও কীটসের কাব্য, সাথে অবশ্যই ইলিয়টস, বায়রন কোনটাই বাদ দেন নি।
এবং বিশ্বভারতীর প্রথম বছরের গ্রাজুয়েট ছিল। সাথে অবশ্য আরেকজন ছিল, গুজরাটের বাচ্চুভাই শুক্লাই। 

এতক্ষণ যেই পাগলাটির (অবশ্যই এইখানে পাড়ার মোড়ে সিদ্দিক পাগলার কথা ভুলেও মাথায় আনবেন না, বলে দিলাম কিন্তু) কথা বললাম, সেটি কে?

কে আর হবে, সৈয়দ মুজতবা আলী।

ও আচ্ছা। মুজতবা আলী। রম্যলেখক। বেশ ভালো লেখেন হে। বেশ রসিয়ে রসিয়ে। চোখ দুটোতে শান্তি পাওয়া যায়।

এই যে ঝামেলা বাধিয়ে ফেললেন! কেন বাপু, লেখা পড়ে যদি মুখ ফুটে হাসি ভুল করে বেরিয়ে পড়ে তাহলেই কি তাকে রম্যলেখক বলব! রম্যরচনা বলে তো তাকে ভাঁড়ামির পর্যায়ে নামিয়ে দিলেন।
মানছি, তিনি হাতে গোণা কয়েকখানা ভ্রমণকাহিনী (আবার আত্নজীবনীও বলা যায়) আর গুটিকয়েক উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু বাকি সব তো প্রবন্ধ!
এখানে আমার মতো আহাম্মকের কোন এক বিজ্ঞজনের স্মরণীয় বচন টেনে নিয়ে আসা উচিত। এবং সেটাই করছি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন,

...একটা সময় ছিল যখন ঠাট্টা করে বলা হতো, যে লেখা পড়লে কিছুই মানে বোঝা যায় না, তারই নাম আধুনিক কবিতা। সেই রকমই, এক সময় এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল যখন যে লেখা পড়তে ইচ্ছেই করে না, তারই নাম ছিল প্রবন্ধ। সৈয়দ মুজতবা আলীই প্রবন্ধকে সেই অকাল মৃত্যুদশা থেকে বাঁচিয়েছেন...”


তাহলে কি তাকে প্রবন্ধকার বলব?
কিরে বাবা! এত কারক-বিভক্তি সহযোগে বিভক্তিকরণ কেন!  
বাংলা সাহিত্য যদি প্রমথ চৌধুরীর নিকট ঋণী থাকে, তবে তার উত্তরসুরী হিসাবে মুজতবা আলীর উপরেও কিছু দায়ভার বার্তায়। যেভাবে তিনি শব্দকে ব্যবহার করেছেন, শব্দকে তার বহুবিধ লৌকিক অঞ্চল থেকে মুক্ত করে সাহিত্যে প্রবাহিত করেছেন, মানুষের উচ্চারণগত বাণীভঙ্গিকে নির্মিত বাক্যের মধ্যে স্পষ্ট করতে চেয়েছেন তার তুলনা হয় না। তিনি নিজেই নিজের তুলনা। তার রচনা দিনের আলোর মতন স্পষ্ট, ঝর্ণার জলের মতন স্বচ্ছ। কলম ধরেছিলেন আড্ডা দেওয়ার জন্য (!) সামনে স্ব-শরীরে উপস্থিত নেই, তাতে তার বয়েই গেছে! শুরু আড্ডা। একে একে উঠে আসতে লাগল পাশের বাড়ির মেসোমশাই থেকে ওমর খৈয়াম, কায়রোর কাফে, রবীন্দ্রকাব্যের তত্ত্ববিশ্লেষণ, হিন্দু বা ইসলামী ধর্মকথার মর্মার্থ, সুইজারল্যান্ডের পার্কের বেঞ্চি পাশাপাশি বর্বর জার্মানের কথা, হিটলারের বিবাহকালীন আবেদনপত্র থেকে সংগীতনৃত্য সবকিছুই! অথচ কোন দাম্ভিকতা নেই! আর আপনিও তন্ময় হয়ে শুনে যাচ্ছেন। আর মনে মনে বলছেন, বাহ! খয়ের, না থুক্কু খাসা!
কর্মহীন, অলস, উদ্দেশ্যহীন আড্ডার ঢঙ্গে বলে গেলেও কথাগুলো কিন্তু অনেক কাজের কথায় ভর্তি, জ্ঞান-অভিজ্ঞতা, শাস্ত্রচর্চা ও সার্থক সমালোচনায় ঠাসা। কিন্তু, বাংলায় যাকে বলে মাষ্টারি করা সেটার অস্তিত্ব পাবেন না।

মুজতবা আলীর নাম বড় দুটো অভিযোগের (!) একটা হলো, বড্ড বেশি ভবঘুরে স্বভাবের! বঙ্গ সন্তানের পক্ষে এত ছুটোছুটি কি মানায়!

“...দেশভ্রমণ করেছি, এরকম একটি খ্যাতি আমার আছে। এ সম্বন্ধ্যে কোনও প্রকার উচ্চবাচ্য আমি করিনে। অর্থাৎ আমি যেসব ভূমি দেখেছি, শুধুমাত্র সেগুলোর সাদামাটা বর্ণনা দিয়েই ক্লান্ত থাকি। দেশভ্রমণ ভালো কি মন্দ, কোন কোন দেশে গিয়েছিলাম এ সম্বন্ধ্যে কোনও প্রকার ইঙ্গিত দেবার প্রয়োজন মনে করিনে। অথচ, আমার বহু সহৃদয় পাঠক ধরে নিয়েছেন যে, আমি দেশভ্রমণের নাম শুনলেই মুক্তকচ্ছ হয়ে তদ্দন্ডেই বন্দর পানে ধাওয়া করি...”


কিন্তু কি করার, যে মূলা খাওয়া হয়েছে, ঢেকুরে তার গন্ধ অবশ্যই থাকবে।

“...শিক্ষার এক মূল অঙ্গ ছিল তীর্থভ্রমণ, দেশভ্রমণ বলিলে একই কথা বলা হয়।প্রশ্ন এই, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তো অজস্র ডিগ্রী প্রতি বৎসর অকৃপণভাবে বর্ষণ করেন, কিন্তু কখনও তো বিদ্যার্থীকে বার্ষিক পরিক্রমার সময় জিজ্ঞেস করে না, ‘তুমি দেশভ্রমণ করিয়াছ, ভারতবর্ষের অখন্ড রূপ হৃদয়ে আঁকিবার চেষ্টা করিয়াছ?বোধহয় করা হয় না, তাই যখন সাধারণ বাঙালি গ্র্যাজুয়েট লিলুয়ার টিকিট কাটে তখন বলিয়া বেড়ায়, ‘ভাই, কী আর করি, হাওয়া বদলাইতেই হয়, পশ্চিমে চলিলাম!’...”

তা যাক গে, এই বিষয়ে কষ্টের কথা না বাড়াই। এবার আসি তার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগটির কথা! বাঙ্গালি অলস, পেটুক, সর্বভুক। তাই বাঙালি প্রবাদ আছে ‘লোহা খাইনে শক্ত বলে’ কিংবা ‘“...” খাইনে গন্ধ বলে’। এসবকিছু মানলাম, কিন্তু কথা হচ্ছে কতজন আসলে খেতে পারে (বলে কি! আমি নিজে কি খেতে পারি না, নাকি?) বা খাওয়াতে পারে (এটা শুনে কয়েকজনের হার্ট বিট বেড়ে যাওয়া উচিত! নেমকহারাম কোথাকার! এতকিছু খাওয়ালাম, আর বলে কিনা খাওয়াতে পারি না!) কিংবা সবচেয়ে উপযুক্ত কতজন শুধু লিখেই আপনাকে খাবারের স্বাদের অনুভূতি দিতে পারে (এবার কে কি বলবে শুনি?)

“...ঘ্রাণে যদি অর্ধ ভোজন, শ্রবণে তাহলে কোয়ার্টার ভোজন!...”

কিন্তু শুধুমাত্র, লেখনীর জোরে খাবারের সম্পূর্ণ স্বাদ আপনাকে দিচ্ছে এবং কখনও ফাউ হিসাবে আপনাকে লালা ঝরাতে (!) বাধ্য করছে, কয়জন বাঙ্গালির পক্ষে এমনটা সম্ভব!

“... বাঙ্গালির সর্ষে-ইলিশ, মালাই-চিংড়ি, ডাব-চিংড়ি, বাঙালি বিধবার নিরামিষ (বিশেষ করে ‘বোষ্টমের পাঁঠা’ এঁচোড়), জলখাবারের লুচি, আলুর দম, শিঙাড়া, মাছের ডিমের বড়া, মোচার পুর দেওয়া সামোসা ইত্যাদি, তার পর ছানার মিষ্টি, রসগোল্লা, লেডিকিনি, সন্দেশ, চিনিপাতা দই, মিহিদানা-সীতাভোগ আরও কত কী! (মুদ্রাকর মহাশয়, আপনার জিভে জল আসছে, অথচ এ-লেখা কম্পোজ না করে আপনার বাইরে যাবার উপায় নেই, তদুপরি আজকের দিনে আপনি-আমি কেউই এসব সুস্বাদু বস্তু চাখবার সামর্থ্য রাখিনে, অতএব অপরাধ নেবেন না।) এমনকি আমাদের উচ্ছেভাজা, আমের অম্বল, কিসমিস-টমেটোর টক (প্রধানত বীরভূম, মেদিনীপুর অঞ্চলের) নগণ্য জিনিস নয়, ভোজনরসিক মাত্রেই জানেন। আর পিঠে- তার ফিরিস্তি আর দেব না।...” 

কিংবা

“... বয়স হয়েছে, যখন খুশি রেস্তোরাঁয় ঢুকে মামলেট-কাটলেট হুকুম দিতে লজ্জা করে। আর যখন বয়স হয়নি তখন জেবে সিঙ্গিল চায়ের রেস্ত থাকত না বলে রেস্তোঁরায় ঢোকবার উপায় ছিল না।
ভগবান দয়াময়। তিনি সবকিছুই দেন, কিন্তু তার ‘টাইমিং’টা বড্ডই খারাপ। বৃদ্ধকে দেন তরুণী ভার্যা এবং হোটেলে যাবার পয়সা। উনিশ শতকের নাটক-নবেলে একেই বলা হত ‘অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস’।...”

হাস্যরসের কমতি না থাকলেও, এই রসের পেছনে যে করুণ রুপটি গেয়ে চলেছে, মুজতবা আলীর লেখায় একে উপেক্ষা করে যেতে পারবেন না।

“...বাপ-দাদা করেছিলেন তাই আমিও ভগবানে বিশ্বাস করি গতানুগতিকভাবে, কিন্তু যদি এ কালো মেয়ের কোনওদিন বর জোটে তবেই ভগবানে আমার সত্যকার বিশ্বাস হবে...”
কিংবা সিলেটি খলাশিটির কথা। যে দেশের স্ত্রী এবং জাহাজের চাকরী পরিত্যাগ করে মেম বিবাহ করে আত্নগোপন করে আছে। লেখক গিয়েছিলেন তাকে ফিরিয়ে আনতে কিন্তু স্ত্রী এবং শিশুদের দেখে মুখ ফুটে বলতে পারলেন না সেকথা। আশ্চর্য করুণ মধুর সে কাহিনী।

তার ছোট ছোট লেখাগুলোতে প্রচুর হাস্যরস থাকলেও তার অধিকাংশ উপন্যাস এবং গল্পে করুণ রসই বেশি। শবনম উপন্যাস পড়তে পড়তে অনবরত চোখের জল মোছে না, সে পাষন্ড ছাড়া আর কিছুই না।

সর্বশেষে, এক বিজ্ঞ চীনা ব্যক্তি জনৈক ইংরেজকে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বুঝিয়ে বলেছিলেন, “সরোবরে জল বিস্তর কিন্তু আমার কাপ ক্ষুদ্র। জল তাতে উঠে সামান্য। কিন্তু আমার শোক নেই। মাই কাপ ইজ স্মল, বাট আই ড্রিংক অফতেনার”
একই কথা সৈয়দ মুজতবা আলীর সৃষ্টিকর্মের পক্ষেও প্রযোজ্য...

                                    

Comments

Popular posts from this blog

বাংলা রহস্য গল্পের ইতিহাস

বিনীতা এখন কেমন আছো

ইজমের ঘরবসতি (পর্ব ১)