ফোকাসলাইট

দূর থেকে তাকালে মনে হবে লোকটি খুব স্বাভাবিক আছে। আর দশটা সাধারন মানুষের মতোই অফিসে বসে আছে। না, বসে নেই। সামনে পড়ে থাকা ফাইলগুলো নিয়ে আছেন। কিন্তু আপনি যদি শার্লক হোমস কিংবা অন্ততপক্ষে তার ভক্ত হলে চলবে, তাহলে আপনার কেন জানি মনে হবে, না, সবকিছু ঠিক নাই! কোথাও কিছু একটা সমস্যা হয়েছে!

তবে, সান্তনা এই যে, আপনার শার্লক হোমসের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। তবে শর্ত প্রযোজ্য! এবং শর্ত হচ্ছে, আপনার আশেপাশে বকরউদ্দিন সাহেবকে থাকতে হবে। তবে বকরউদ্দিন সাহেবের মেজাজটা আজকে বিশেষ ভালো নেই। কারণ, কিছুই না, সকালবেলা অফিসে আসার পর প্রায় পনের মিনিট হতে চলল কিন্তু লোকটির চা খাওয়ার কোন নামগন্ধও নাই। এদিকে আবার তার নিজের চায়ের পিপাসা একশ দুই ডিগ্রিতে পৌছে গেছে। কি যন্ত্রনা! বিশ মিনিট পার হওয়ার পরেও লোকটির চায়ের জন্য কোন হাঁকডাক নেই! না রে ভাই, চায়ের নেশা বড়ই ভয়াবহ! যারা খায় তারা ভালোমতই জানে।
না। বকরউদ্দিন সাহেবের পক্ষে আর বসে থাকা সম্ভব নয়।

কি ব্যাপ্যার, শরীরটা খারাপ নাকি?
এই কয়েকটা শব্দের প্রভাবে লোকটির যে প্রতিক্রিয়া হল তার পরিমাণটা আর একটু বেশি হলে তার সামনে রাখা পানিপূর্ণ গ্লাসটা আর তার নিজের অবস্থানটা বজায় রাখতে পারতো বলে মনে হয় না।
এ অবস্থায় আপনার মনে লোকটা সমন্ধে দুইটি ধারনা হতে পারে। এক, লোকটি হয়ত তার কাজ নিয়ে খুব ব্যাস্ত। আর দুই, নয়ত লোকটি ভাবুক প্রকৃতির। সাবধান! আপনার প্রথম ধারনাটির সম্পর্কে যদি লোকটি জানতে পারে, তবে আপনার নামে মানহানির মামলা হতে পারে। আর দ্বিতীয় সম্ভাবনাটির ক্ষেত্রে, লোকটির পরম শত্রুকেও জিজ্ঞেস করলেও, তাকে এই অপবাদ দিতে পারবেন না।

না,এখনও লোকটি তেমন কিছু ভাবছে না। শুধু মনের মাঝে আটকে থাকা একটা খটকা আছে। সকালে অফিসে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় উনার ১৩ বছরের ছেলেটি হঠাৎ করে এসে একটা লং ডিসটেন্স বাইনোকুলারের আবদার করে। তা করুক, একটা বাইনোকুলারের দাম আর কত হবে? হাজার দুয়েক? কিন্তু এত জিনিস থাকতে এইটা কেন? এই একটা প্রশ্ন সারাটা সকাল তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।
বলেন কি বাইনোকুলার? আরে ভাই, এটা আবার কোন কিনে দেওয়ার মতো জিনিস হল? না, ভাই, এসব জিনিসপত্র কিনে টাকাপয়সা নষ্ট করার কোন মানে হয় না। তারচেয়ে বরং এমন জিনিস কিনে দেন যেটা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।
 
হুম, আমিও সেটাই ভাবছিলাম।
 

বকরউদ্দিন সাহেবের আরও কিছু বলার ইচ্ছা থাকলেও লোকটির এমন উত্তাপহীনতা তাকে নিজের টেবিলে ফিরে আসতে বাধ্য করল। মানুষের বিচার-বুদ্ধি আসলেই দিন-দিন কমে যাচ্ছে, এটাই আসতে আসতে তার মনে হল।

ডিকসনারি মুখস্ত করা জ্ঞানীদের মতে পৃথিবীতে নাকি আলোর বেগ সবচেয়ে বেশি, কিন্তু তারা কি জানে গুজবের বেগ কত? আর লোকটির অফিসে গুজব যে কি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছড়ায় সে সমন্ধে আপনার কোন ধারনাই নেই! তবে আপনি বুঝতে পারবেন যে গুজব ছড়িয়েছে, যদি দেখেন সরকার আলিকে ছটফট করতে।
এই সরকার আলির একটু পরিচয় দেওয়া দরকার। সরকার আলি হচ্ছে এই অফিসের সবচেয়ে আবেগপ্রবণ লোক। যেকোন ঘটনায় বিচলিত হতে পারেন। লোকটির এমন অবস্থা শোনার পরে তিনি আর থাকতে পারলেন না। অবশ্য তার কানে পৌছেছিল লোকটির ছেলেটা একটা কামান চেয়েছে।

অবশেষে সরকার আলির ছটফটানি কমল যখন লোকটির কাছে আসল খবর জানতে পারল যে, ছেলেটি যেটা চেয়েছিল সেটা কামানর নয় বাইনকুলারের।
সর্বনাশ! বলেন কি
? আপনার বাড়ির আশেপাশে কোন উঠতি বয়সী মেয়েমানুষ আছে নাকি? আপনার ছেলের দিকে একটু ভালোমতো লক্ষ্য দিয়েন। বয়সটা তো খুব একটা ভালো না। আরে সেদিনেই তো পাশের টেবিলের জামান সাহাবের কলেজ পড়ুয়া ছেলেটা কি করে বসল।
তাই বলি কি ছেলে বড় হচ্ছে, একটু দেখে শুনে রাখুন। বলা তো যায় না, কখন কি হয়!  


এতসব ঘটনার পর অফিস শেষে বাড়ি ফেরার পথে একবারের জন্য হলেও লোকটির মনে হয়েছিলো, ছেলেটা তো খুব বেশি কিছু একটা চায়নি, কি হবে কিনে দিলে। কিন্তু তক্ষুনি যে তিনি শুনতে পেলেন কি যেন বলে উঠল, ভাই সাবধান।

কিছু দিন বা সপ্তাহ কিংবা মাস, আবার বছরও হতে পারে। এক সকাল বেলা। লোকটি বসে আছে। তবে এবার অফিসে নয় তার বাড়িতে।
 

এইটা একটু পড় তো।
না, লোকটির স্ত্রী বাজারের ফর্দ পড়তে বলছে না। তিনি একটা ছোট বাঁধাই করা খাতা লোকটির দিকে এগিয়ে দিলেন। খুব চেনাচেনা মনে হচ্ছে। ওহ! মনে পড়েছে, এটা তো সেই খাতা যেটা ছেলের ১১তম জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন, এই খাতাটা তোমার। একেবারেই তোমার। তোমার ভালোলাগা, ইচ্ছেগুলো সব-সবগুলো এই খাতাটাতে লেখা থাকবে। কেমন?
তারপর
, দেয়ালের পাশের টিকটিকিটার টিকটিক আওয়াজের সাথে কতবার সকাল হয়েছে, আবার রাত হয়েছে সেটার কোন হিসেব ছিল না। সেই সাথে কথাগুলোও ফিকে হয়ে এসেছিল। আজ খাতাটির সাথে জড়িত পুরোনো স্মৃতিগুলো যেন জোয়ার ভেঙ্গে উপচে পড়ল।
 
আমার রুমে একটা জানালা আছে। জানালাটা দিয়ে আকাশের অনেকটাই দেখা যায়। মা সেদিন বলেছিল, আমাদের পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষেই নাকি চিন্তা-ভাবনা
, কাজেকর্মে আলাদা-আলাদা। হতে পারে।
কিন্তু আমরা যে আকাশটা দেখি সেটাও কি আমাদের মতোই আলাদা আলাদা
? আমার কেন জানি মনে হয়, প্রত্যেক মানুষের আকাশ আসলেই একটা।
তাই আমি এই আকাশটা দেখতে চাই। আরও বেশী ভালো করে দেখতে চাই। আর সবার মত না। একটু অন্যভাবে। কিন্তু আমি তো খালি চোখে বেশি কিছু দেখতে পারব না! অন্তত যদি একটা বাইনোকুলার থাকত। বাবাকে বলেছি এনে দিতে। কেমন জানি অবাক হয়েছিল!


একটা দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ পেলাম। কিন্তু আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সেটা ঠিক কার দীর্ঘশ্বাস বুঝে উঠতে পারলাম না।


Comments

Popular posts from this blog

বাংলা রহস্য গল্পের ইতিহাস

বিনীতা এখন কেমন আছো

ইজমের ঘরবসতি (পর্ব ১)