অব্যাক্ত
১৮৪৮ সাল। সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখ। সময় আনুমানিক বিকাল
সাড়ে ৪ টা। যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্টে
রুটল্যান্ড-বারলিংটন রেলপথ বসানোর কাজ বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে চলছিল। শ্রমিকদের সেই
দলে ফোরম্যান হিসাবে নিযুক্ত ছিল ফিনেস গেজ (Phineas Gage)। বয়স ২৫ বছর। যে সময়ের কথা বলছি সে সময়ে রেলপথ নির্মাণের জন্য রাস্তা তৈরি করতে গানপাউডার
ব্যাবহার করা হত। সেদিনেও রাস্তা তৈরির কাজ পুরোদমে চলছিল। কিন্তু একটা সমস্যা
হয়ে গেল! গানপাউডার চার্জ করার
সময় ভুলবশত এক দুর্ঘটনা ঘটে যায়। দুর্ঘটনায় বেশ কয়েকজন আহত হলেও সবচেয়ে বেশি আঘাত
পান আমাদের
পরিচিত ফিনেস গেজ। গানপাউডার চার্জ করার জন্য তার হাতে যে
লোহার রডটি (ওজন ছিল প্রায় ১৩.২৫ পাউন্ড!) ছিল সেটা তার বাম
গালের উপর দিয়ে মাথার ভেতর প্রবেশ করে!
এ ধরনের দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যাক্তিরা সাধারনত ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করে, কিন্তু
আশ্চর্যজনকভাবে গেজ বেঁচে যান। এবং ঘটনাস্থল থেকে নিজে
উঠে দাড়ান, তারপর শহরে ডাক্তারের কাছে
যাওয়ার জন্য কথা বলতে বলতে গাড়িতে উঠে বসেন!
(এ পর্যন্ত যদি পড়ে থাকেন, তাহলে অবশ্যই গাঁজাখুরি গল্প বলে মনে হতে পারে। কিন্তু, হোরেশিও, স্বর্গে ও মর্ত্যে এমন অনেক কিছু আছে!)
(এ পর্যন্ত যদি পড়ে থাকেন, তাহলে অবশ্যই গাঁজাখুরি গল্প বলে মনে হতে পারে। কিন্তু, হোরেশিও, স্বর্গে ও মর্ত্যে এমন অনেক কিছু আছে!)
তাকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় ড. এডওয়ার্ড এইচ
উইলিয়ামসের কাছে। পরে নিয়ে যাওয়া হয় ড. জন মার্টিন হার্লোওর
কাছে। ড. হার্লোওর ভাষ্যমতে, সেদিন সন্ধ্যার পরেও
গেজ সচেতন অবস্থায় ছিল এবং তার সহকর্মীদের চিনতে পারছিল, সেই সাথে দুই-একদিনের
মধ্যে কাজে ফেরত যাওয়ার ইচ্ছা ব্যাক্ত করেছিল!
মাঝে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেও পরবর্তিতে ফাঙ্গাল ইনফেকশনের কারনে
সেপ্টম্বরের ২৩ থেকে অক্টোবরের ৩ তারিখ পর্যন্ত গেজকে প্রায় কোমায় যেতে হয়েছিল।
অক্টোবরের ৭ তারিখের দিকে কিছুটা সুস্থ হয়ে গেজ প্রথমবারের মত হাঁটাচলা করতে পারেন এবং ১১ তারিখের দিকে অন্যান্য স্বাভাবিক কাজকর্মের সাথে সাথে তার চিন্তা-ভাবনায় উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। ড.
হার্লোওর কাছ থেকে জানা যায়, এসময় গেজ বেশ ভালোমতই
তার দুর্ঘটনার কথা মনে করতে পারতেন এবং সেই ঘটনার কতদিন হয়েছে তাও হিসাব করতে
পারতেন। তবে তার টাকা-পয়সার হিসাবে বেশ সমস্যা হত। এবং এই ঘটনার এক মাস পরে গেজ
প্রায়ই বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় দাড়িয়ে থাকতেন।
সুস্থ হয়ে ডাক্তারের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে গেজ
চলে যান তার বাবা-মার কাছে নিউ হ্যাম্পশায়ারে। শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেও
দুর্ঘটনায় তার বাম চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল যার কারনে তার পক্ষে আর
পূর্বের ফোরম্যানের কাজ করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। যার কারনে পরবর্তি জীবনে গেজ বিভিন্ন
রকমের কাজ করে বেড়িয়েছে, কখনও চিলিতে মালবাহী ওয়াগন চালিয়েছেন আবার
ক্যালিফোর্নিয়াতে কৃষিকাজও করেছেন।
এই দুর্ঘটানার পরে গেজ আরো ১৩ বছরের মত বেঁচে ছিলেন। শেষের দিকে হৃদরোগ আর মৃগীরোগে বেশ কিছুদিন ভোগার পরে ১৮৮০ সালে ২০ শে মে গেজ মারা যান। সেসময় তার বয়স হয়েছিল ৩৮ বছর।
এর সাত বছর পরে তার মৃতদেহটি উদ্ধার করা হয় এবং ড. হার্লোও মৃতদেহটি এবং সাথে সেই লোহার রডটি নিজের কাছে রেখে দেন। বর্তমানে মৃতদেহ এবং লোহার রড দুটোই হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ওয়ারেন এনাটোমিক্যাল মিউজিয়ামে সরক্ষিত অবস্থায় আছে।
এবার কিছু আপাত দৃষ্টিতে গুরুত্বহীন প্রশ্নে আসা যাক,
এই দুর্ঘটনা গেজের আচার-আচরনে কি কোন পরিবর্তন এনেছিল? নাকি সে আগের মতই ছিল?
- - অনেকেই বলে থাকেন দুর্ঘটনার পূর্বে গেজ অনেক কঠোর পরিশ্রমী এবং বেশ
হাসিখুশি ছিল কিন্তু পরে সে রাগী, বদমেজাজী ও মাতাল হয়ে পড়েন; যে কারনে কোন কাজ সে
বেশি দিন ধরে রাখতে পারেন নি।
এটা কি সত্য? সেই ভয়াবহ রকমের দুর্ঘটনা কি তার আচার-আচরনের এতটাই পরিবর্তন এনেছিল?
- মনোবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিক ম্যালকম ম্যাকমিলান। বর্তমানে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে রয়েছেন। ১৯৭০ সালের দিকে তিনি গেজের ঘটনাটি নিয়ে
আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং এর পিছনের আসল ঘটনা জানার জন্য অনুসন্ধানে নেমে পড়েন।
অনুসন্ধান করতে যেয়ে তিনি দেখতে পান কিভাবে একটি ঘটনা আস্তে-আস্তে মিথে পরিনত হয়!
এবং তার অনুসন্ধান নিয়ে তিনি লিখেন “An Odd King of Fame: Stories of Phineas Gage”। বইটিতে তিনি বলেন, গেজের আচার-আচরণ সম্পর্কিত এই গুজবের পিছনে একটি খবরের কাগজের রিপোর্টের
গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা রয়েছে। গেজের দুর্ঘটনার কয়েকদিন পরে এক স্থানীয় খবরের কাগজে
এটি নিয়ে একটি রিপোর্ট করা হয় যাতে ভুলবশত কয়েকটি ভুল তথ্য চলে আসে, যেরকম, গেজের
আগের জীবন, লোহার রডটি ওজন ইত্যাদি। যেগুলো কালক্রমে পরবর্তিতে মিথে পরিনত হয়।
আসলেই কি সম্পূর্ণ ব্যাপারটা মিথ! যদি মিথে রাজ্য থেকে বেরিয়ে একটু বিজ্ঞানের দিকে ঢুঁ মারি, তাহলে
কি খুব একটা সমস্যা হবে? মনে হয় খুব একটা সমস্যা হবে না। ঠিক আছে, তাহলে দেখা যাক কি পাওয়া যায়।
তো একটু আগে যেটা বলেছিলাম, গেজের মৃত্যুর সাত বছর পরে তার মৃতদেহটি উদ্ধার করা হয়। অর্থাৎ, স্বাভাবিকভাবেই তার মস্তিষ্কটি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়ে উঠে নি। যদি সংরক্ষণ করা সম্ভব হত, তাহলে অবশ্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু পাওয়া যেত। কিন্তু যেহেতু সেটা আর করা হয়ে উঠে নি, কাজেই বিজ্ঞানীদের পক্ষে তো আর হাহুতাশ করে বসে থেকে লাভ নেই। এবং তারা কাজে লেগে গেলেন। কি নিয়ে?
গেজের করোটির কঙ্কালটি নিয়েই!
তো একটু আগে যেটা বলেছিলাম, গেজের মৃত্যুর সাত বছর পরে তার মৃতদেহটি উদ্ধার করা হয়। অর্থাৎ, স্বাভাবিকভাবেই তার মস্তিষ্কটি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়ে উঠে নি। যদি সংরক্ষণ করা সম্ভব হত, তাহলে অবশ্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু পাওয়া যেত। কিন্তু যেহেতু সেটা আর করা হয়ে উঠে নি, কাজেই বিজ্ঞানীদের পক্ষে তো আর হাহুতাশ করে বসে থেকে লাভ নেই। এবং তারা কাজে লেগে গেলেন। কি নিয়ে?
গেজের করোটির কঙ্কালটি নিয়েই!
হুহ! এইটা দিয়ে আর কি হবে! খালি একখান হাড়!
সাধু সাবধান! দেখতে চাইলে হাড়ের মধ্যেও অনেক কিছু দেখার চোখ লাগবে যে।
পুরোনো বস্তাপচা কাসুন্দি না ঘেঁটে, একটু সমসাময়িক কাজকর্মের দিক চোখ বুলানো যাক। জ্যাক ভান হর্ন। ইউএসএ’র ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপক। নিউরোসায়েন্টিস্ট এবং নিউরোইমাজিং বিশেষজ্ঞ। ২০১২ সালের দিকে তিনি গেজের করোটি নিয়ে উঠেপড়ে লাগলেন। লোহার রডটি ঠিক কতগুলো
তারমানে ম্যাকমিলানের দাবীনুযায়ী গেজ নিয়ে প্রচলিত সকলকিছুই মিথ এটা সম্ভব হচ্ছে না। যেহেতু দূর্ঘটানার আগে তার অবস্থা ঠিক কিরকম ছিল সে সম্পর্কে ভালোমত কোন তথ্য পাওয়া যায় না, তাই ঠিক করে বলা সম্ভব না, কতখানি পরবর্তন তার মাঝে হয়েছিল। তবে হর্নের মডেল অনুযায়ী এতটুকু সত্য যে তার মাঝে অবশ্যই কিছু না কিছু পরিবর্তন হয়েছিল।
Comments
Post a Comment