মিলগ্রাম এক্সপেরিমেন্টঃ নির্মমতা কি জন্মগত?

“মহাশয়, আপনি কাহার পক্ষে, যুদ্ধের না শান্তির? বৎস, আমি শান্তির পক্ষে, কারণ শান্তির সময় পুত্র পিতার কবর খনন করিয়া থাকে, আর যুদ্ধের সময় পিতা পুত্রের।”


এটা ছিল গ্রীক দার্শনিক হেরাক্লিটাস এবং তার শিষ্যের মধ্যকার কথোপকথন। যুদ্ধ নিয়ে আমরা যতই বলি না কেন, যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা/ যুদ্ধ মানে আমার প্রতি তোমার অবহেলা। তবে একথাকে অস্বীকার করা যাবে না, যুদ্ধের সময় জেনারেলের এক আদেশেই কত হাজার-হাজার নিরীহ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে! 

কুখ্যাত জিউ হলোক্যাষ্ট, কিংবা রুয়ান্ডার গণহত্যা অথবা মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের দেশেই যে গণহত্যগুলো হয়েছিল সেগুলোর দিকে নজর দিলে “মানবতা” কিংবা “মানবিকতা” ইত্যাদি শব্দগুলো হারিয়ে যায়। কিভাবে একজন মানুষ হয়ে নির্মমভাবে এতগুলো মানুষকে হত্যা করতে পারে!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় একটি কথা বেশ উচ্চারিত হয়েছিল, যেসকল সৈনিক এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ছিল তারা কেবল উপরওয়ালার হুকুম পালন করেছে মাত্র! তাহলে কি নিজস্ব বিবেক বলি, আর বিবেচনাবোধ যাই বলি না কেন এগুলো কি একসময় কতৃপক্ষের হুকুমের কাছে মাথানত করে ফেলে?

প্রফেসর স্ট্যানলি মিলগ্রাম, ইয়েল ইউনিভার্সিটির একজন সাইকোলজিষ্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সংগঠিত নাৎসিদের হত্যাকাণ্ডের পেছেনে আসলেই কি উপরস্থ কতৃপক্ষের আদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের ভূমিকা ছিল, এই প্রশ্ন মাথায় রেখে ১৯৬১’র জুলাইয়ে শুরু হয় এক গ্রাউন্ডব্রেকিং এক্সপেরিমেন্ট।

ইয়েল ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরিতে মেমরি সংক্রান্ত একটি এক্সপেরিমেন্টে নেওয়ার জন্য ২০ থেকে ৫০ বছর বয়সসীমার মধ্যে কিছু পুরুষ পার্টিসিপেন্ট চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়।
আগ্রহীদের নিয়ে পরবর্তীতে আরেকজনের সাথে জোড় বাঁধানো হয়, যেখানে একজনকে “শিক্ষার্থী” এবং অন্যজনকে “শিক্ষক” এর ভূমিকা পালন করতে বলা হয়। মূলত পার্টিসিপেন্টদেরকে শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে বলা হয়, কেননা কারা শিক্ষার্থী হবে সেটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। এবং শিক্ষার্থীর ভুমিকায় আগে থেকেই যে মানুষ ঠিক করে রাখা হয়েছিল, এবং সেটি পার্টিসিপেন্টদের জানানো হয়নি।
‘শিক্ষক’ ভূমিকায় অঙ্গশগ্রহণকারী পার্টিসিপেন্টদের বলা হলো, এক্সপেরিমেন্টের উদ্দেশ্যে শিক্ষার ক্ষেত্রে শাস্তির ভূমিকা কতখানি সেটা যাচাই করা। এখানে শাস্তি হিসাবে দেওয়া হবে ইলেক্ট্রনিক শক! ১৫ ভোল্ট থেকে শুরু করে ৪৫০ ভোল্ট মাত্রার ইলেক্ট্রিক্যাল শক!
কোন প্রশ্নের উত্তর না পারলে প্রথমে ১৫ ভোল্টের শক এবং পরবর্তিতে প্রতিবার শকের মাত্রা ১৫ ভোল্ট করে বাড়ানো হবে।

‘শিক্ষক’ এবং ‘শিক্ষার্থী’ দুজনের জন্য দুটি আলাদা কক্ষ ব্যবহার করা হয় যাতে শিক্ষক তার ছাত্রকে দেখতে না পায়, কিন্তু তার আওয়াজ যেন শোনা যায়। একটিতে ইলেক্ট্রিক চেয়ারে বসা ‘শিক্ষার্থী’ এবং অপরটিতে ‘শিক্ষক’ ও তার সাথে ধূসর রঙের ল্যাব এপ্রোন পরা একজন এক্সপেরিমেন্টর।

এরপরের কাজ হলো ‘শিক্ষক’ কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবেন। ‘শিক্ষার্থী’ যদি সেপ্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর দিতে পারে, তাহলে পরের প্রশ্ন। আর যদি ভুল উত্তর হয়, তাহলে ইলেক্ট্রিক শক জেনারেটরের একটি বোতাম টিপবেন যাতে করে ‘শিক্ষার্থী’ শক খায়। প্রতিবার ভুলের জন্য ‘শিক্ষার্থী’ শক খাবে এবং প্রতিবার শকের মাত্রা ১৫ ভোল্ট করে বৃদ্ধি পাবে।

এখানে বলে রাখি, কাউকেই সত্যিকারের শক দেওয়া হয়নি। ‘শিক্ষার্থী’ ভূমিকায় অংশগ্রহণকারীদের আগে থেকেই বলা হয়েছিল তারা যেন শকের মাত্রা দেখে ক্রমশ জোরে জোরে চিৎকার করে যন্ত্রণার অভিনয় করে। কিংবা প্রয়োজন হলে চিৎকার করে যাতে জানায় যে তারা শক সহ্য করতে না পেরে মারা যাচ্ছে। এমন অবস্থায় কতজন মানসিকভাবে সুস্থ মানুষ অন্যকে ৪৫০ ভোল্টের শক দেবে?

আসলে এক্সপেরিমেন্টের শুরুতেই পার্টিসিপেন্টদের উপর এক সার্ভে চালানো হয়েছিল। যেখানে তাদের প্রশ্ন করা হয়, ৪৫০ ভোল্ট মানে নির্ঘাত মৃত্যু। আপনি কত ভোল্টে জ্ঞান হারাবেন? অধিকাংশের উত্তর ছিল ১৩৫ ভোল্ট। এরপরে প্রশ্ন করা হয়, আপনি নিজে অন্যকে ৪৫০ ভোল্ট পর্যন্ত শক দেবেন? এক্ষেত্রে কারো উত্তর ‘হ্যাঁ’ ছিল না। কিন্তু বাস্তব পরীক্ষায় এর কোন সমর্থন পাওয়া গেল না!

‘শিক্ষার্থী’র চিৎকারে দ্বিধাগ্রস্থ ‘শিক্ষক’ যখন বলা হলো কাজটা করতেই হবে, কেননা সেটাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সেটাই নির্দেশ, তখন অনেকেই মানলেন সেই হুকুম। শেষপর্যন্ত ৪৫০ ভোল্ট শক দিলেন কতজন? 
৪০ জন এর মধ্যে ২৬ জন, অর্থাৎ ৬৫% মানুষ! এবং প্রত্যেক পার্টিসিপেন্ট অন্ততপক্ষে ৩০০ ভোল্ট পর্যন্ত শক দিয়েছেন।

এই এক্সপেরিমেন্ট পরিবর্তিতে আবার করা হয়, তবে কিছুটা পরিবর্তিতে রুপে। এক্সপেরিমেন্টে ‘শিক্ষক’এর সাথে একজন ধূসর রঙের ল্যাব এপ্রোন পরা (একধনের ইউনিফর্ম) একজন এক্সপেরিমেন্টর ছিল, যে কিনা ‘শিক্ষক’কে শক দেওয়া চালিয়ে যেতে বলে। পরবর্তিতে এই এক্সপেরিমেন্ট যখন আবার করা হয় তখন এইধনের ইউনিফর্ম পরিহিত এক্সপেরিমেন্টরের পরিবর্তে সাধারণ পোশাকের একজন এক্সপেরিমেন্টর ‘শিক্ষক’কে শক দেওয়া চালিয়ে যেতে বলে। এক্ষেত্রে দেখা যায় কতৃপক্ষের নির্দেশের প্রতি অনুগত্য প্রকাশ প্রায় ২০% কমে গেছে!
আবার যদি এক্সপেরিমেন্টর কর্মস্থানে উপস্থিত না থেকে টেলিফোনের মাধ্যমে নির্দেশ দেয় সেক্ষেত্রে আনুগত্য প্রকাশ কমে গেছে ২০.৫%।
এবং ইয়েল ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরিতে এক্সপেরিমেন্টটি না করে অন্য জায়গায় করে দেখা গিয়েছে, এবার নির্দেশের প্রতি আনুগত্য কমে গেছে একেবারে ৪৭.৫%! 

মিলগ্রামের মতে মানুষ তখনই কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মেনে নেয় যখন কিনা তাদের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মে তাদের কাজের ফলাফল যাই হোক না কেন এর সম্পূর্ণ দায়ভার নেবে করতৃপক্ষ।
তার এক্সপেরিমেন্ট আমাদের দেখিয়ে দিল,
জনগণের এক বড় অংশ তাই করে, যা তাদের করতে বলা হয়। ওপরওয়ালা নির্দেশ দিচ্ছেন জানলে, ভাবে না কাজের চরিত্র নিয়ে, মানে না বিবেকের বাধা। সাধারণ মানুষ, নিজের কাজে মত্ত হয়ে অন্যের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন না হয়েও হতে পারে অত্যাচারের অংশীদার।
 

Comments

Popular posts from this blog

বাংলা রহস্য গল্পের ইতিহাস

বিনীতা এখন কেমন আছো

ইজমের ঘরবসতি (পর্ব ১)