দাগ থেকে যদি ভালো কিছু হয় তবে!

ছোট একটা গল্প বলি। ছোট একটা বাচ্চার গল্প। ছোট বললে কি হবে ততদিনে রীতিমত কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে রোজ স্কুলে যাওয়া-আসা শুরু করে দিয়েছে। ছড়া শুনে, রাইম পড়ে, ছবি আঁকে, গান গায় আরো কত্ত কি। কিছুদিন পরে দেখা গেলো স্কুলের বাংলা, ইংরেজি কিংবা অন্যান্য বিষয়গুলো আয়ত্তে চলে এলেও ঐ অংকটা জানি তার কাছে কেমন কেমন মনে হচ্ছে। প্রথম প্রথম একটা একটু ভয় ভয় লাগত কিন্তু আস্তে আস্তে দেখা গেলো অংকের নামটা শুনলেও গলাটা কেমন জানি শুকিয়ে আসছে! বুক ধড়ফড় করে!

এবার আরেকটা গল্প। মানুষটা কিন্তু আগে থেকে এরকম ছিল না। আগে অন্তত বিয়ে-শাদী, জন্মদিনের মতন অনুষ্ঠানগুলোতে সবার সাথে তেমন একটা কথাবার্তা না বললেও অন্তত যেয়ে চুপচাপ খেয়েদেয়ে চলে আসত। আর এখন যে কি হলো যাওয়া তো দূরের কথা এরকম কিছুতে যেতে হবে শুনলেই যেন পালিয়ে বাঁচে! 



     সময়টা ছিল বিহেভিওরিজমের (Behaviorism), কগনেটিভ সাইকোলজি (Cognitive Psychology) তখনো আসি আসি করছে। ‘মন’ নামক রোমান্টিকদের প্রিয় রহস্যময় এই বস্তুটিকে অনেকদিন ধরেই কাঁটাছেড়া চললেও গত আঠারো শতকের শেষের দিকে এই প্রথম ‘মন’কে ল্যাবরেটরির ভেতরে আনা হয়। কিন্তু তখনো সেটা ছিল খাঁচার ভেতরের অচিন পাখি যাকে দেখতে পাই না, ধরতে পারি না। এমন সময়ে উনিশ শতকের শুরুর দিকে স্কুলের কড়া রাশভারী মাষ্টারের মত বিহেভিওরিজম এসে বলল, এসব কিছু চলবে না। সাইকোলজি, বাংলায় যেটাকে মনোবিজ্ঞান বলছি সেটাকে যদি বিজ্ঞান বলে দাবি করি থাকি তাহলে অন্যান্য বিজ্ঞানের শাখাগুলোর মতন এটিও অদৃশ্য কোনকিছু নিয়ে কাজ করলে হবে না বরং তাকে অবশ্যই দেখতে পেতে হবে এবং সেই জিনিশ মাপজোগের জন্য নির্দিষ্ট করে কিছু নিয়মকানুন থাকতে হবে। বিষয়টি অনেকটি এরকম মনে করুন, আপনার ক্ষুধা পেয়েছে। আগেরকার কাজগুলো ছিল ক্ষুধা পেলে আপনি কি চিন্তা করেন, তখন আপনার কেমন লাগে এইসব। বিহেভিওরিজম এসে বলল আপনি কি চিন্তাভাবনা করেন এসব জরুরী না, জরুরী হচ্ছে সেসময় আপনি কি করেন অর্থাৎ, সেসময় কি আপনি চিৎকার করেন, নাকি দৌড়ে গিয়ে খাবারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন নাকি নাকমুখ ফুলিয়ে চুপচাপ বসে থাকেন এটা লক্ষ্য করাটা গুরুত্বপূর্ণ। আর এভাবেই ‘মন’ নামক দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-আয়তনহীন যে জিনিশটি আছে তার গঠন, কাজের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা যাবে।    

১৯৬৫ এর এমন সময়ে পেনসালভানিয়া ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ড. মার্টিন সেলিজম্যান এবং স্টিভেন মায়ার মিলে ক্লাসিক্যাল কন্ডিশনিং (Classical conditioning) নিয়ে কাজ করার সময় দূর্ঘটনাবশত এমন একটা কাজ করে ফেলনেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে কি হতে পারে এ সম্পর্কে কোনো ধারণাই তাদের ছিল না।
ক্লাসিক্যাল কন্ডিশনিং বলতে যেটা বোঝায় মনে করুন, আপনার ভালোবাসার মানুষটিকে প্রথম যেদিন দেখেছিলেন সেদিন তার পরনের যে জামাটি ছিল পরবর্তিতে সেই রঙের কোন জামা দেখলেই সেদিনের সেই অনুভূতিগুলো আপনার কাছে ফেরত আসতে থাকে, অর্থাৎ জামার ওই রঙটির সাথে আপনার কন্ডিশনিং হয়ে গিয়েছে।

সেলিজম্যান এবং মায়ার কুকুর নিয়ে এরকমেই কাজ করছিলেন। একটা বাক্সে কুকুরটিকে রেখে ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া হত। তবে ঐ শক দেওয়ার আগে একটা শব্দ করা হত। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেলো ঐ শব্দ শোনার সাথে সাথেই কুকুরটি বুঝে যেত এরপর তাকে শক দেওয়া হবে। অর্থাৎ, ইলেক্ট্রিক শকের সাথে কুকুরটির কন্ডিশনিং হয়ে গিয়েছে। এরপর তারা করল কি কুকুরটিকে
আরেকটা বাক্সের মধ্যে রাখল যেটির মাঝখানে ছোট একটি বেড়ার মতন ছিল ইচ্ছে করলেই টপকে একদিক থেকে আরেকদিকে চলে যাওয়া যায়। নতুন এই বাক্সের একদিকে শক দেওয়ার ব্যবস্থা আছে আরেকদিকে নেই। এবার কুকুরটিকে শক দেওয়ার পর দেখা হলো সেটি কি বেড়া টপকিয়ে অপর পাশে পৌঁছুচ্ছে কিনা। দেখা গেলো শক দেওয়ার পরেই কুকুরটি যে পাশে ছিল সেখানে রয়ে গিয়েছে, বেড়া টপকিয়ে আর পার হলো না।
এরপর আরেকটি কুকুর নেওয়া হলো যাদের এবারেই প্রথম শক দেওয়া হবে। এদের ক্ষেত্রে দেখা গেলো কয়েকবার শক দেওয়ার পরেই তারা ঠিকেই বেড়া টপকিয়ে সেটা থেকে বাঁচবার উপায় বের করে ফেলেছে।


প্রথম কুকুরটির এমন আচরণ লক্ষ করে সেলিজম্যান সেটাকে ব্যাখ্যা করলেন Learned Helplessness হিসাবে অর্থাৎ, আপনি যখন শিখেছেন আপনি যতই চেষ্টা করুন না কেন আপনি আসলে অসহায়; আপনি একজন পথহারা পথিক এখন আপনার সামনে যতই পথ এসে হাজির হোক না কেন আপনি দাঁড়িয়েই থাকবেন কেননা অতীত বলেছে আপনি পথহারা।

এখন যতই সাদৃশ্য থাকুক, কুকুর নিয়ে গবেষণা করে যে ফলাফল পাওয়া গিয়েছে সেটা মানুষের ক্ষেত্রে কতটুকু সংগতিপূর্ণ এবং যুক্তিসংগত এই প্রশ্ন থেকে যায়। এ নিয়ে ১৯৭৮ সালে আব্রামসন, সেলিজম্যান ও টিসডেল দেখান যে সেলিজম্যান যে Learned Helplessness এর কথা বলেছেন সেটাতে দুটো সমস্যা থেকে যাচ্ছে,

এক, ঠিক কোন ক্ষেত্রে এটি সকলের জন্য প্রযোজ্য হবে আর কখন নির্দিষ্ট ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য হবে।
দুই, ঠিক কখন এটি সকল কিছুর জন্য নির্দেশ করবে আর কখন নির্দিষ্ট কিছুর জন্য নির্দেশ করবে সেটি নিয়ে ধোঁয়াশা থেকে যায়।

এই গবেষকত্রয়ী মিলে বের করলেন এটা নির্ভর করে মূলত কোন ঘটনার কারণ হিসাবে কাকে দায়ী করছি তার উপর। মনে করুন, কোন একটি পরীক্ষায় খারাপ করে বসলেন। এখন কারণ হিসাবে আপনি বলছেন “পড়ি নাই, পড়লে পারতাম” এর প্রভাব যেমন পড়বে আপনি যদি দায়ী করেন “প্রশ্ন বাজে হইছে তাই পারি নাই” তার থেকে ভিন্ন হবে। আবার মনে করুন ক্লাশের সকলের কাছে যদি মনে হয় “প্রশ্ন ভালো না, কিচ্ছু লেখা সম্ভব না” তাহলে যে প্রভাব পড়বে তার থেকে শুধু আপনার একার কাছে যদি মনে হয় “আপনি এই জিনিশ পড়তে ভালো লাগে না তাই খারাপ করেছেন” অবশ্যই ভিন্ন।

অর্থাৎ, ভবিষ্যতে কি হচ্ছে সেটা নির্ভর করছে অতীতের কোনকিছুকে আপনি বর্তমানে কীভাবে দেখছেন তার উপর।     


Comments

Popular posts from this blog

বাংলা রহস্য গল্পের ইতিহাস

বিনীতা এখন কেমন আছো

ইজমের ঘরবসতি (পর্ব ১)