আমরা কেন ঘুমাই?
হাস্যকর বলে মনে হলেও খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তরের ক্ষেত্রে বড় একটি সীমাবদ্ধতা
হলো, নির্দিষ্ট কোন কার্যকরণটি (causal-effect)
ঘুমের সাথে জড়িত সেটি আমরা বলতে পারি না! যেকারণে ঘুমের কারণ খুঁজতে
যেয়ে আমাদের বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যার দ্বারস্থ হতে হয়েছে।
ইভালিউশনারি সাইকোলজির দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে, ঘুম আমাদের মধ্যে একধরণের টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে রয়েছে। আদিম অবস্থায়, রাতে চলাফেরা করা বেশ বিপদজনক ছিল। এসময়ে দেখা গেল, যে সকল প্রানী রাতে চলাফেরা করত তারা বেঁচে থাকা কিংবা অন্যন্য ক্ষতির ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে চুপচাপ থাকা প্রাণীদের চেয়ে বেশি সুবিধা পেত। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে টিকে থাকার এই পদ্ধতি ঘুম হয়ে প্রানীর মধ্যে রুপান্তরিত হয়েছে।১ কিন্তু, নিরাপত্তাই যদি ঘুমের কারণ হয়ে থাকে, তাহলে সেটা কতটা যথাযথ এবং বিশেষ করে নিশাচর প্রানীদের ক্ষেত্রে কতখানি যুক্তিসংগত এরকম বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়।
কেন ঘুমাই, এর সমসাময়িক একটি ব্যাখ্যা হলো, ঘুমের সাথে মস্তিষ্কের গঠনের পরিবর্তনের (Brain Plasticity) একটি ভালো সম্পর্ক আছে। যদিও এই সম্পর্ক এখনো ভালোভাবে নির্ণয় করা সম্ভব না হলেও ঘুমের সাথে এর সম্পর্ক বেশ ভালোমতন বোঝা যায়।৪ ছোট বাচ্চা বা শিশুদের মস্তিষ্কের গঠনে ঘুম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যে কারণে শিশুরা ১৩ থেকে ১৪ ঘন্টা ঘুমিয়ে কাটায় এবং অধিকাংশ সময়ে সে কাটায় রেম-ঘুমে (REM sleep)।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের Allan Rechtschaffen Sleep Laboratory’র একটি গবেষোণায় পানির উপরে একটি ক্রমাগত ঘুর্ণায়মান চাকতির উপর কিছু ইঁদুর রাখা হয় এবং তাদের মস্তিষ্কের তরঙ্গ প্রতিনিয়তই মাপা হচ্ছিল। দেখা যায়, টানা অনেকদিন ধরে ইদুরকে ঘুমাতে না দেওয়া হলে প্রায় তিন-চার সপ্তাহের মধ্যেই ইদুরগুলো মারা যায়।
আমাদের অনেকেই ধারণা করে থাকি, ঘুমের সময়ে আমাদের মস্তিষ্কের যাবতীয় কাজকর্ম বন্ধ থাকে। সত্যিকার অর্থে, ঘুমের মাঝেও আমাদের মস্তিষ্ক তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। এসময় আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর সাহায্যে পাওয়া সকল তথ্যগুলো তার ধরণ অনুযায়ী যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি (Long Term Memory) হিসাবে জমা হয়। ২০০৯’এর দিকে কয়েকজন আমেরিকান এবং ফ্রেঞ্চ গবেষকরা মিলে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির পিছনে Sharp Wave Ripples নামে মস্তিষ্কের মধ্যকার এক ক্ষুদ্র তরঙ্গের প্রভাব উল্লেখ করেন।৬ এই ক্ষুদ্র তরঙ্গগুলোর মাধ্যমে মস্তিষ্কের হিপোক্যম্পাস (hippocampus) থেকে বিভিন্ন তথ্য নিয়োকর্টেক্সে (neocortex) চলে যায়, যেখানে দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিগুলো জমা থাকে। গবেষকরা দেখেন, গভীর ঘুমের মধ্যে এই Sharp Wave Ripples সবচেয়ে বেশি প্রবাহিত হয়।
কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজের আগের রাত কিংবা ছাত্রদের ক্ষেত্রে বলা যায় পরীক্ষার আগের রাতে অনেকেই টেনশনে ঘুমাতে পারে না, আবার অনেকেই পরীক্ষার পড়ার কারণে ঘুমায় না। এবং যদি পরীক্ষা ভালো হয়ে যায়, তাহলে এর জন্য সারারাত জেগে পড়াকে একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করে। এভাবে প্রতি পরীক্ষার আগের রাতে বা গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর আগের রাতে না ঘুমানোর একটা রেওয়াজ তৈরি হয় এবং ক্রমেই নিজের মধ্যে একধরণের বিশ্বাস জন্মে, আমি না ঘুমিয়ে অনেক ভালো কাজ করতে পারি (!) বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এভাবে না ঘুমিয়ে কাজ করে যতই ভালো ফলাফল পাওয়া যাক না কেন, একটা সময় সেটাই আপনার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। একটানা ১৯ ঘন্টা জেগে থাকার ফলে অনেক সময় মস্তিষ্কের কিছু কোষ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।৭
আমাদের না ঘুমানোর রোগ ইনসোমনিয়ার (Insomnia) কথা জানা আছে কিন্তু, ঘুমাতে ভয় পায় এরকম কোন কিছুর কথা শোনা হয়েছে কি? বিষয়টা আপনার মজার হলেও সত্যিকার অর্থেই একদল মানুষ আছে, যারা কিনা ঘুমাতে ভয় পায়! এরকম ঘুমাতে ভয় পাওয়াকে বলা হয় সোমনিফোবিয়া (Somniphobia) কিংবা হিপনোফোবিয়া (Hypnophobia)। তাদের এই ঘুমাতে ভয় পাওয়ার কারণ হিসাবে পাওয়া যায় যে অত্যাধিক দুঃস্বপ্ন দেখার কারনে বা ঘুমের সাথে জড়িত এমন কোন ঘটনা যেটা পরবর্তিতে তার জন্য ভয়াবহ রকমের ক্ষতির কারণ হিসাবে দাঁড়িয়েছে। ভালো কথা, হরর মুভি কিন্তু সোমনিফোবিয়ার ট্রিগার হিসেবে কাজ করে।৮

সর্বশেষ কথা, ঘুম সম্পর্কিত আমরা যে তথ্যগুলো জানি সেগুলো মূলত বিগত মাত্র ২৫ বছরের গবেষণার মাধ্যমে পাওয়া। আমরা এখনও ঘুম সম্পর্কিত অনেক অনেক কিছুই সঠিকভাবে জানি না; অনেকটা অনুমান আর অনেকটা দীর্ঘদিনের কুসংস্কারের মধ্য দিয়েই আমরা ঘুমকে ব্যাখ্যা করে আসছি। আরো অনেক, অনেক কাজ করার আছে এই ঘুম নিয়ে।
তথ্যসুত্রঃ
১, ২ Siegel JM. 2005. Clues to the functions of mammalian sleep. Nature. 437:1264-1271৩ Porkka-Heiskanen T. 1999. Adenosine in sleep and wakefulness. Annals of Medicine. 31:125-129.
Comments
Post a Comment